গুরুগ্রামে শিবসেনা নবরাত্রি উপলক্ষে বন্ধ করিয়া দিল মাংসের দোকানগুলি। প্রায় ৫০০ মাংসের দোকানকে গুন্ডামি করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া তাহারা বলিয়াছে, এতগুলি হিন্দু উপবাস করিতেছে, বা মাংস আহার হইতে বিরত থাকিতেছে, এই পরিবেশে অন্য কেহ মাংস খাইবে কী করিয়া। কে কী খাইবে বা না খাইবে সে বিষয়ে অন্য কাহারও নাক গলাইবার অধিকার আছে কি না, এই প্রশ্ন ভারতে আর করা চলে না, কারণ সরল উত্তর হইল, মৌলবাদীরা অন্যের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকিয়া পড়িয়া নিদান হাঁকিবে, ইহাই আধুনিক ভারতীয় বৈশিষ্ট্য, যাহাকে মৌলবাদীরা বলেন, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য। অবশ্য কেবল ভারতকে দুষিলে তাহা সংগত হইবে না। রণবীর কপূর ও পাকিস্তানি অভিনেত্রী মাহিরা খানের নিউ ইয়র্কের পথে ভ্রমণরত ছবিতে দেখা গেল, মাহিরা খান কিনা মহিলা হইয়া এবং মুসলিম হইয়া সিগারেট খাইতেছেন ও পৃষ্ঠপ্রকাশী পোশাক পরিয়াছেন। হইহই করিয়া তাঁহাকে নিন্দা ও অপমান করিতে নামিয়া পড়িল টুইটারের ধর্মান্ধ জঙ্গি বাহিনী। বলিউডের বহু অভিনেতা এই প্রবণতার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছেন, কে কী পরিবে, কে কেমন নেশা করিবে, এইগুলি নির্ধারণ করিবার অধিকার অন্য কাহারও নাই। কিন্তু কে কাহাকে বিবাহ করিবে বা প্রেম করিবে তাহা কে ঠিক করিবে? অবশ্যই খাপ পঞ্চায়েত বা রাজনৈতিক দলগুলি, কারণ মুসলিম পুরুষের সহিত প্রেম করিবার অপরাধে দলিত নারীকে বারংবার চপেটাঘাত করিতেছেন বিজেপি নেত্রী, এই ছবি ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এমন অভিযোগও উঠিয়াছে: কোচি-র এক যোগ কেন্দ্রে আটক রাখা হইয়াছে কিছু হিন্দু মহিলাকে, যাঁহারা অন্য জাতির পুরুষকে বিবাহ করিয়াছেন। উঁহাদের ‘ঘর ওয়াপসি’-র প্রক্রিয়া শীঘ্রই শুরু করিবার পরিকল্পনা রহিয়াছে নিশ্চয়।
ইতিমধ্যে জার্মানিতে দক্ষিণপন্থী এএফডি দলটি সাম্প্রতিক নির্বাচনে চমৎকার ফল করিল। এই দল প্রশ্ন করে, জার্মানি কেন ইউরোপের অন্য দেশের দারিদ্র মোচনে সাহায্য করিবে, কেন লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিবে, কেন কেবল নিজ চরকাতেই তেল দিবে না। এই স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতাই ইদানীং দেশপ্রেম বলিয়া বহু দেশে প্রচারিত। ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে নারাজ হইতেছে, তাহার সমর্থনে প্রাজ্ঞ কলমচিও বলিতেছেন, দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করিয়া মানবিকতা ফলানো মোটে উচিত কার্য নহে। যে কোনও মূল্যে মানবিকতাকে ধরিয়া রাখাই যে মানুষের ধর্ম, তাহা বলিবার লোক কম পড়িয়াছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প বলিতেছেন, আমেরিকান ফুটবলে যে খেলোয়াড়রা কোনও কিছুর প্রতিবাদে জাতীয় সংগীতের সময় উঠিয়া দাঁড়াইতে নারাজ হন তাঁহাদের অর্ধচন্দ্র দিয়া বাহির করিয়া দেওয়া উচিত। তিনি দেশবাসীকে ন্যাশনাল ফুটবল লিগ বয়কট করিতেও উৎসাহিত করিয়াছেন। ইহার পরে, বহু খেলোয়াড় জাতীয় সংগীতের সময় একটি হাঁটু গাড়িয়া বসিতেছেন, প্রতিবাদের অধিকারকে সম্মান জানাইতে। এই ধরনটির শুরু গত বৎসর, যখন কলিন কেপারনিক নামে এক খেলোয়াড় জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়াইতে অস্বীকার করেন, শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের হত্যার ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে। এখন ট্রাম্পের কথার বিরুদ্ধে অনেকে বলিতেছেন, কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, কেপারনিক এই মুহূর্তে কোনও দলেই খেলিতে পান না, তিনি ব্রাত্য। অবধারিত ভাবে মনে পড়িবে, ভারতের সিনেমা হলগুলিতে জাতীয় সংগীত বাজাইবার প্রথা, এবং কেউ সেই সময় উঠিয়া দাঁড়াইতে অস্বীকার করিলে সাধারণ দর্শক কর্তৃক তাঁহার প্রহার বা অপমানের কথা। আসলে, যখন কোনও রাষ্ট্রনায়ক বা শাসক দল দন্ত ও নখর বাহির করিয়া কিছু মানুষকে আক্রমণে উদ্যত হন এবং অসহিষ্ণুতাকে করতালি দিয়া অভিনন্দিত করিতে থাকেন, তখন বহু শান্তিপ্রিয় মানুষের মনেও উদ্ধত হিংস্র মনোভাব ফণা তুলিতে উদ্যত হয়, বা হিংস্র মানুষের দলে যোগ দিয়া নিজেকে বৃহত্তর সমষ্টির অংশ বলিয়া ভাবিবার লোভ জাগে। এনএফএল-এর এই প্রতিবাদী খেলোয়াড়দেরও বহু সমর্থক গ্যালারি হইতে তিরস্কার করিতেছেন, সমাজমাধ্যমেও গালির বন্যা বহিতেছে। আর বাংলায় দুর্গাপূজায় একটি নির্দিষ্ট পেশার মানুষের প্রতি ক্রোধ রূপায়িত হইতেছে দুর্গাপ্রতিমার সম্মুখে অসুর হিসাবে তাঁহাদের চিত্রিত করার মহান কার্যে। অবশ্য পরে অসুরের মূর্তিকে তড়িঘড়ি অন্য রূপ দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু সমগ্র বিশ্বে সংকীর্ণতা ও মস্তানির এই উত্থান ও বিস্তারকে অত সহজে অন্য রূপ দেওয়া যাইবে কি?
যৎকিঞ্চিৎ
বিজ্ঞাপন দিয়ে বলব মাইকে ঘোষণা করব আমাদের ঠাকুর দেখুন দুর্দান্ত ঠাকুর গড়েছি আর থিমও অভিনব জবরদস্ত, তার পর মানুষ লাইন দিয়ে প্যান্ডেলে ঢোকামাত্র তাদের পাঁচনবাড়ি নিয়ে তাড়া লাগাব ‘চলুন চলুন সরুন সরুন বেরোন বেরোন অন্যদের দেখতে দিন’, এই অসামান্য ভদ্রতার অন্ত ঘটল এ বছরের মতো। এই উদ্যোক্তাদের যদি কেউ ‘দারুণ ছবি হয়েছে’ বলে সিনেমা হল-এ নিয়ে যায়, আর নাম দেখানো হয়ে গেেলই ‘চলুন এ বার অন্যদের দেখতে দিই’ বলে বের করে আনে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy