Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার স্বধর্ম

যে কোনও দেশেই যখনই সমাজ ও রাজনীতি কোনও অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে ভাবুকরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, যেমন হয়েছিলেন ফ্রান্সের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকে ভলতের, ঊনবিংশ শতকে এমিল জ়োলা, বিংশ শতকে জঁ পল সার্ত্র। 

দ্রোহী: দার্শনিক-লেখক জুটি জঁ পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার। গেটি ইমেজেস

দ্রোহী: দার্শনিক-লেখক জুটি জঁ পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার। গেটি ইমেজেস

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৯ ০০:৪৮
Share: Save:

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লির এক সভায় অমর্ত্য সেন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, “মাঝে মাঝে অ্যান্টি-ন্যাশনাল হওয়া ঠিক আছে, রাষ্ট্রই আমাদের একমাত্র পরিচয় না।” (আবাপ ২৮-২)। সারা ভারত ব্যাপী যে এক আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধজিগিরের ধুম পড়েছে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই উক্তি। ফিরে দেখা যাক ইতিহাসের পাতায়, অষ্টাদশ ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের ফরাসি সমাজে ভাবুকদের গায়েও কেমন দেগে দেওয়া হয়েছিল দেশদ্রোহীর তকমা।

যে কোনও দেশেই যখনই সমাজ ও রাজনীতি কোনও অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে ভাবুকরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, যেমন হয়েছিলেন ফ্রান্সের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতকে ভলতের, ঊনবিংশ শতকে এমিল জ়োলা, বিংশ শতকে জঁ পল সার্ত্র।

১৮৭০-এ জার্মানির কাছে ফ্রান্সের শোচনীয় পরাজয়ের বেদনা তখন দগদগে। ফরাসি জাত্যভিমান আহত। তার ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে এল France Juive (ইহুদি ফ্রান্স) নামের একটি বই। লেখক এদুয়ার দ্রুমঁ নামের উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদিবিদ্বেষী ব্যর্থ এক সাংবাদিক। বইতে উদাহরণ তুলে ধরে বোঝানো হল, নৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরে ফ্রান্সের যত নষ্টের গোড়া ওই ইহুদিরা। প্রকৃত দেশপ্রেমিক ফরাসিরা ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষ, ইহুদিরা বহিরাগত দেশদ্রোহী।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে ঘটল দ্রেফুস-কাণ্ড। ফরাসি ইহুদি এক সামরিক অফিসার আলফ্রেদ দ্রেফুস ফেঁসে গেলেন জাতশত্রু জার্মানিকে অস্ত্রের নকশা পাচারের দায়ে। সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন হল। ইহুদি বলে স্রেফ সন্দেহের বশে তাঁকে বলা হল দেশদ্রোহী, বন্দি করা হল তৎকালীন ফরাসি গুয়ান্তানামো বে, ফ্রেঞ্চ গায়নার দ্বীপভূমিতে, এক জেলখানায়। দ্রেফুস-পত্নীকে ফরাসি রাষ্ট্র শাসালো, ‘‘স্বামীকে যদি না হারাতে চাও তো মুখ বন্ধ রাখো।’’ ফ্রান্স, বিশেষত ফ্রান্সের কলমজীবীরাও দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়লেন। এক দিকে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ‘দেশভক্ত’, উল্টো দিকে গণতন্ত্র-প্রিয় তথাকথিত দেশদ্রোহী। দ্বিতীয় শিবিরে অগ্রগণ্য এমিল জ়োলা দ্রেফুসের সমর্থনে তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রপতিকে নিশানা করে l’Aurore পত্রিকায় লিখলেন J’cccuse... (অভিযোগের আঙুল তুলছি)। কার দিকে? যে অপরাধীরা আজকের এই অন্ধকারের জন্যে দায়ী রাষ্ট্রের সেই সব প্রতিনিধির দিকে, বললেন জ়োলা। তিনি জানতেন এর জন্য হয়তো তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে ১৮৮১-র সংবাদ সংক্রান্ত আইনের ৩০ ও ৩১-এর ধারায় মানহানির অপরাধে শাস্তির খাঁড়া। কী আছে সে আইনে? সংবাদপত্রে বিচারব্যবস্থা সামরিক বাহিনী ও সর্বোপরি দেশের রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রী-সান্ত্রির বিরুদ্ধে কথা বলা বা অবমাননাকর মন্তব্য করা যাবে না। জ়োলার সপক্ষে স্বাক্ষর দিলেন অকতাভ মোরো, আনাতোল ফ্রঁস, শার্ল পেগি, মার্সেল প্রুস্ত-এর মতো সাংবাদিক ও সাহিত্যিকরা, জর্জ ক্লেমঁসো ও জঁ জোরেস-র মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। এই আন্দোলনের জেরেই কিন্তু অবশেষে দ্রেফুস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন, মুক্তিলাভ করেছিলেন।

দ্রেফুস-কাণ্ডে জ়োলার ভূমিকার সঙ্গে তুলনা টানা হয় কালাস-কাণ্ডে ভলতের-এর ভূমিকার। অষ্টাদশ শতকে একচক্ষু বিচারব্যবস্থার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন ভলতের। এই কালাস-কাণ্ডের প্রেক্ষিতেও প্রচ্ছন্ন ছিল ধর্মান্ধতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ। পুত্রহত্যার দায়ে অভিযুক্ত জঁ কালাস ছিলেন প্রটেস্টান্ট। ‘সাত বছরব্যাপী তৎকালীন যুদ্ধ’-এ ক্যাথলিক ফ্রান্স জড়িয়ে পড়েছিল মুখ্যত দুই প্রটেস্টান্ট দেশ ইংল্যান্ড ও জার্মানির সঙ্গে। অতএব প্রটেস্টান্ট হওয়া মানেই তৎকালীন ফ্রান্সে বিধর্মী ও দেশদ্রোহী। প্রটেস্টান্ট ধর্ম-প্রচারও অপরাধের পর্যায়ে পড়ত। গুজব রটেছিল, জঁ কালাসের পুত্র ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণ করবে বলে মনস্থ করেছিল। সেই আক্রোশে নাকি পিতা পুত্রকে হত্যা করেন। কালাসকে বাঁচানো যায়নি, তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ভলতের কলম ধরেছিলেন, লিখে ফেলেছিলেন Traité sur la Tolérance (সহনশীলতা বিষয়ে সন্দর্ভ)। এর ফলে পরে অভিযুক্তের নির্দোষিতা প্রমাণ হয়েছিল।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সের উপনিবেশগুলি একে একে মুক্তি ঘোষণা করা শুরু করল। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হল আলজিরিয়ায়। এই মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ফরাসি সমাজ আবার দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। ফ্রান্সের ভাবুকদের একটা বড় অংশ ফ্রান্সের সামরিক আগ্রাসনের সরাসরি বিরোধিতায় নামলেন। একে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন আখ্যা দিলেন। ১৯৬০-এ ১২১ জনের স্বাক্ষরিত এক ইস্তাহার প্রকাশিত হল Vérité-Liberté (সত্য-স্বাধিকার) পত্রিকায়। কে নেই সে তালিকায়! অঁদ্রে ব্রতোঁ, মারগরিত দ্যুরাস, মরিস ব্লঁশো, সিমোন দ্য বোভোয়ার, জঁ পল সার্ত্র। ফরাসি হয়েও ফ্রান্সের এই কৃতী সন্তানেরা কিন্তু সে দিন ফরাসি রাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী বক্তব্য রেখেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন “(ফ্রান্সের বিরুদ্ধে) আলজিরিয়ার মানুষের এই লড়াই, যা চিরতরে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ করছে, সে লড়াই সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের লড়াই। সুতরাং সে যুদ্ধকে সমর্থন করা ফরাসিদেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’’

বুদ্ধিজীবী কে? সার্ত্র বলছেন, এটা ঠিক, জ্ঞানচর্চার জগতে পেশাদার যাঁরা, এক অর্থে তাঁরাই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। ভাবুকের ধর্ম পরিস্ফুট হয় যখন তিনি তাঁর পেশার মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। তিনি সর্বজনীন সত্যের সাধক। যখন এই সর্বজনীনতাকে তাঁর পরিপার্শ্বে ব্যাহত হতে দেখেন, দেখে নিপীড়ক-নিপীড়িত ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব, বিভাজন, তখনই তিনি প্রকৃত অর্থে ভাবুক হয়ে ওঠেন। যখন এক জন পরমাণুবিজ্ঞানী দু’দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখতে পান ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত বোধ করে বিরোধিতায় নামেন, তখনই তিনি প্রকৃত ভাবুক হয়ে ওঠেন। তাঁর পরিপার্শ্বের সঙ্কটকে ভাবুক নিজের মধ্যে, নিজের পেশাদারি জ্ঞানচর্চার মধ্যে ছায়া ফেলতে দেখেন এবং তাকে নিবিড় ভাবে অনুভব করে বিচলিত হন।

তাই হয়তো তিনি জড়িয়ে পড়েন এমন সব ক্ষেত্রে যা তাঁর নিজস্ব পেশাদারি ক্ষেত্র নয়। ভাবুক সম্পর্কে এই অপবাদ সর্বকালে সর্বত্র শোনা গিয়েছে। এমিল জ়োলা তো আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, পেশাদারি আইনের খুঁটিনাটি তাঁর জানার কথাও নয়। কোন অধিকারে তিনি আইনের ন্যায্যতা নিয়ে কথা বলেন? বস্তুত, সর্বজনীন সামাজিক ন্যায় ও মঙ্গলকে তিনি অনুভব করেছিলেন তাঁর লেখক সত্তা দিয়ে। তাই তাঁকে ও তাঁর সহযাত্রীদের সাহায্য করেছে অন্যায্য আইনি সিদ্ধান্তকে চিহ্নিত করতে।

রাজনৈতিক দল, বা রাষ্ট্র প্রতিনিধিদের মতো ভাবুক বিশ্বকে নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ক্ষেত্র মনে করেন না, তাকে খণ্ডিত করে দেখেন না, কিছু সর্বজনীন সূত্রের মধ্যে দিয়ে এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তাই তিনি দল দেশ জাতি পেশাদারি ক্ষেত্রের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর স্তরে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে চান। ভাবুকের পেশা ধর্ম দেশ জাতি সবই থাকে, কিন্তু এ গণ্ডির মধ্যে তাঁর আবদ্ধ হয়ে থাকা চলে না। কারণ এই পরিচিতিগুলি কম-বেশি প্রোথিত ক্ষমতার ভূমিতে। আমার জাতি ধর্ম দেশ নিয়ে আমি আস্ফালন করি অন্য জাতি ধর্ম দেশকে টেক্কা দিতে, তার ওপর ক্ষমতা কায়েম করতে। বুদ্ধিজীবী ভাবুক হয়ে ওঠেন যখন তিনি সুনির্দিষ্ট কোনও পরিচিতির ক্ষমতা-বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jean-Paul Sartre Anti National
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE