নারীর পরিস্থিতি আমাদের দেশে সব ধর্মে সব সমাজেই প্রতিবন্ধকতাময়। আমরা জানি, এটা একান্ত ভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চরিত্রগত সমস্যা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলিম মেয়েদের প্রতিবন্ধকতাকে একটু বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব, তার মূল্যায়নও বিশেষ ভাবে জরুরি। জন্মসূত্রে মুসলিম হওয়ার ফলে কী ভাবে সেই উপলব্ধি জেগেছে, তাই একটু বলি। জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ উপন্যাস যখনই পড়ি, সেই উপন্যাসের বালিকাদের কথা আমাকে নিয়ে যায় আমার ফেলে আসা স্লেট পেনসিল ও চাটাই নিয়ে পাঠশালায় যাওয়ার দিনগুলিতে। আমার বেড়ে ওঠা বীরভূমের প্রত্যন্ত এক পাঠশালাহীন মুসলিমপ্রধান গ্রামে। আমাদের গ্রামে পাঠশালা না থাকায় পড়তে যেতাম প্রতিবেশী গ্রামের পাঠশালায়। আর সেই সূত্রেই প্রথম বার প্রতিবেশী গ্রামের প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মানুষের সংস্পর্শে আসা। দেখেছিলাম, আমাদের ছায়া এড়াতে গ্রামের মহিলারা আমাদের দেখে দেওয়ালে যেন সেঁটে যেতেন। আমরা নিজেরাই ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়তাম: ইস! কী সাংঘাতিক, না? মানুষের স্পর্শে মানুষের জাত যায় এ ভাবে! সেই অভিজ্ঞতার সরণি বেয়ে এলাম শহরে। আরও বেশি করে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হল। সেই অভিজ্ঞতা অম্লমধুর— হয়তো মধুরের চেয়ে অম্লতাই তাতে বেশি।
এই যেমন, এক বন্ধুর বাড়ি এক বছর সরস্বতী পুজোর খিচুড়ি খেয়ে হাত চাটতে চাটতে ঘরে ফিরেছিলাম। ওই বছরের মহরমের দিন প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের বন্ধুটিকে প্রায় একই স্টাইলে রান্না করা নিরীহ খিচুড়ি খাওয়ার অনুরোধ জানালে সে সযত্নে এড়িয়ে গেল। এই যে ‘সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া’, এতে আমি, আমরা, ছোটবেলা থেকেই খুব অভ্যস্ত।
আমাদের সমাজে ছোটরা এ ভাবে এড়িয়ে যেতে যেতেই বড় হয়, কেননা বড়রা ছোটদের মনে প্রথম থেকেই অন্য ধর্মের বা ‘নিচু’ জাতের প্রতি বিদ্বেষ, এমনকি ঘৃণার বীজ বপন করতে থাকেন। অতীত, বর্তমান কোনও সরকারের কোনও সংস্কারই জাত বা ধর্মের ছোঁয়াছুঁয়ি ধরনের সামাজিক অন্যায়ের ধার কমাতে পারেনি। তাই আজও মুসলিম নামের কারণে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় না কলকাতার মতো শহরেও।
ছোটবেলায় শুধু মুসলিম হওয়ার ‘অপরাধ’-এ কিছু মানুষ আমার মনের মধ্যে যে দগদগে ঘা তৈরি করে দিয়েছিলেন, তা মনে করলে আজও বুকে চিনচিনে ব্যথা করে। এ অভিজ্ঞতা আমার একার নয়। অধ্যাপক কোহিনূর বেগম, নার্স রিমা খাতুন, নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক গবেষক, এমনকি কোহিনূর বেগমের মা-ও এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই এসেছেন। যে বন্ধুর সূত্রে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট। বরং এখন তা আরও দৃঢ়। সে দিনের ঘটনার জন্য তো সে নিজে দায়ী ছিল না। আর এখানেই আমি একটা আশা দেখি। মানবিকতার জয়, আবেগের জয়ের আশা।
ক্রমে উচ্চশিক্ষার পথে পা রাখলাম, নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে আলাপ জমালাম। উচ্চশিক্ষায় আসার পর এক নতুন কাণ্ড। আমার আচরণ দেখে, কথা শুনে অনেকেরই নাকি আমাকে ‘মুসলিম’ বলে মনে হত না! ‘‘তুই মুসলিম? তোকে দেখে বোঝা যায় না!’’ যেন মুসলিম মেয়েদের শরীরে ‘মুসলিম’ লেবেল আঁটা থাকে, যেটা আমার নেই।— তুমি মুসলিম? তোমার এখনও বিয়ে হয়নি? তোমার বাবা তো খুব উদার। তোমাদের পরিবেশটা তা হলে অন্য রকম। না হলে মুসলিম মেয়েদের তো পড়াশোনা করতেই দেয় না, অল্প বয়সে বিয়ে হয়।— হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তবে সেটা অমুসলিমদেরও হয়। কেবল মুসলিম মেয়েরাই লেখাপড়া শেখে না এমনটা নয়, বহু হিন্দু ঘরের মেয়েরা আজও স্কুলে যায় না। বরং পরিসংখ্যান বলছে, মুসলমান মেয়েরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে মুসলমান ছেলেদের পিছনে ফেলে দিয়েছে, হিন্দুদের মধ্যে কিন্তু তা হয়নি।
আসলে মুসলিম মেয়েদের জাগরণেরও একটা দীর্ঘ, জটিল ইতিহাস আছে। এ-পার বাংলায় তাঁদের কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছিল দেশভাগ, কিন্তু সময়ের দাবিতে তাঁরাও ক্রমে জেগেছে। প্রচুর প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। সমাজশৃঙ্খলকে শিথিল করে নিজের মতো করে বাঁচার পথ তৈরি করেছেন। নিজের কাজে, নিজের প্রতিভায় নিজের পরিচয় তৈরি করছেন। চার বোন ও মাকে নিয়ে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে নাজনিন মল্লিক সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে ঝাড়গ্রামের সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করতে পারছেন। সুযোগ দিলে তা হলে মুসলিম মেয়েরাও এগোতে পারেন। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারেন।
মানতেই হবে, মুসলিম মেয়েদের এখনও অনেক পথ চলা বাকি। তবে মুসলিম মেয়ে মানেই অশিক্ষিত অল্প বয়সি সাত সন্তানের মা— এই ভাবনাটা দূর হলে কোহিনূর, নাফিসা, রিয়া, হাসনু, সালমাদের পথ চলতে কিছু সুবিধে হতে পারে। জনপরিসরে সংখ্যালঘু মেয়েদের অভিজ্ঞতা শুনতে রবিবার, ২৭ জানুয়ারি কলকাতায় একটি আলোচনাসভায় বসে এই কথাটা বিশেষ ভাবে মনে হল। এবং মনে হল, এই রকম চেনাশোনার বৃত্তটা যদি বাড়ে, তা হলে আরও বেশি করে জানা সম্ভব যে, মুসলিম নারীদের লড়াইয়ের ফলেই মুসলিম মেয়েদের অবস্থার কতটা বদল ঘটছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy