সিগমন্ড ফ্রয়েড। ফাইল ছবি
স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কৌতূহল অন্তহীন। রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে হাল আমলের সাহিত্য— স্বপ্নের কথায় ভরা। অন্যদের কথা ছেড়ে দিলেও, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, গানে, কবিতায় স্বপ্নের কথা বার বার এসেছে। নানা ধর্মীয় আখ্যানেও স্বপ্নের উপস্থিতি রয়েছে। বুদ্ধের জন্মের আগে হাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর মা মায়াদেবী। নানা জনশ্রুতিতেও মাঝেমধ্যেই উঠে আসে স্বপ্নাদেশের কথা। স্বপ্নের মধ্যে দেবতার থেকে আদেশ পেয়ে অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথাও প্রচুর শোনা যায়। স্বপ্ন কিন্তু ফেলনা নয়। কারণ, মানুষের মনের গভীরে নানা ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া বুঝতে এই স্বপ্ন সাহায্য করতে পারে। তাই স্বপ্নকে নিয়ে ভেবেছেন মনস্তাত্ত্বিকেরা। স্বপ্ন দেখার কারণ, তার প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর গবেষণাও হয়েছে।
মানুষের মন নিয়ে কাজ করা মনোবিদদের মতে, স্বপ্নের প্রকৃতি নির্ভর করে বয়স, স্বাস্থ্য, পেশা ও সামাজিক মর্যাদার উপরে। স্বপ্ন সবার আসতে পারে। স্বপ্নকে ভাল ভাবে জানতে গেলে, তাই যে মানুষটি স্বপ্ন দেখছেন তাঁকে ভাল ভাবে জানতে হবে। তবে স্বপ্ন নিয়ে কাজ কিন্তু একে বারেই হাল আমলের নয়। প্রাচীন গ্রিসে, মিশরে স্বপ্নের রহস্যময়তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার হদিস মেলে। যেমন, অ্যারিস্টটল, না কি বিশ্বাস করতেন স্বপ্ন হল দৈহিক শর্তের বিচ্যুতি। আবার, সেই সময়ে কোথাও কোথাও বিশ্বাস করা হত, শুধু অসুস্থ মানুষই স্বপ্ন দেখে। তবে সেই সব কাজের সঙ্গে অবশ্য স্বপ্ন নিয়ে আধুনিক কাজের কোনও মিল নেই।
স্বপ্ন নিয়ে কথা শুরু হলেই বলতে হবে সিগমন্ড ফ্রয়েডের কথা। স্বপ্ন নিয়ে তিনি দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্ন হল ‘মানসিক ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়ার ফসল’। ফ্রয়েড মানব-মনকে সচেতন, অর্ধচেতন এবং অবচেতন— এই তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। তাঁর মতে, ঘুম হল জীবনের অপরিহার্য প্রক্রিয়া বা মানসিক অবস্থা। এই অবস্থায় মানুষের অবচেতন মন, আগে ভাবনাচিন্তা করা বিষয়গুলি বা পুরনো ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম দেখে থাকে। কেমন হয় সেই দেখা? অনেকটা সিনেমার পর্দায় ফেলা আলোকিত ছবির মতো। এবং মানুষ তখন এই প্রক্রিয়াটিকে আসল বলে মনে করেন।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুসারে, মানুষ যখন গভীর ঘুমে থাকে, তখন সে স্বপ্ন দেখে না। গভীর ঘুম ও হালকা ঘুমের মাঝের সময়ই মানুষের স্বপ্ন দেখার সময়। ঘুমের মধ্যে এই সময়কে ‘রেইম স্লিপ’ নাম দেওয়া হয়েছে। এই ‘রেইম স্লিপ’-ই হল স্বপ্ন দেখার প্রকৃত সময়। এই সময়ে চোখের ভিতরে অক্ষিগোলকের দ্রুত সঞ্চালন হয়। একে ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ বলে। ঘুম গভীর হওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষ স্বপ্ন দেখে যেতে পারে। আবার গাঢ় ঘুম, পাতলা হয়ে এলে মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ঘুম যখন গভীর হয়ে আসে, তখন অক্ষিগোলকের সঞ্চালন ক্রমেই স্থির হয়ে আসে। একে ‘সেইম’ বা স্বপ্নহীন স্তর বলে। ফ্রয়েড মনে করতেন, ‘স্বপ্ন হল ঘুমের অভিভাবক’।
কিন্তু মানুষ স্বপ্নে যা দেখে তাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এ ক্ষেত্রে ফ্রয়েডের তত্ত্বকে যৌন প্রতীক নির্ভর তত্ত্ব বলে। ফ্রয়েডের সঙ্গে ছ’বছর কাজ করেছিলেন সুইস মনোবিদ কার্ল গুস্তাভ জুং। স্বপ্ন নিয়ে প্রায় আশি হাজার মানুষের উপরে গবেষণা চালিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের মতে, দৈনন্দিন জীবনে দেখা পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গের প্রতীকগুলি স্বপ্নের মাধ্যমে অবচেতন মনে ঘুরে ফিরে আসে। ফ্রয়েডের মতে এর কারণ, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। ফ্রয়েড দাবি করেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন কম-বেশি তাঁর ‘লিবিডো’-র দ্বারা প্রভাবিত। স্বপ্নে দেখা প্রতিটি প্রতীক মানুষের কাছে বয়ে নিয়ে আসে নির্দিষ্ট তাৎপর্য। বিভিন্ন চাহিদা, ইচ্ছে যা নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে বাধা পেয়েছিল তারা স্বপ্নে ফিরে আসে। পরে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শিশুদের শ্রেণিকক্ষে ভয় দেখানো, বড়দের মানসিক দুশ্চিন্তা, প্রেমে সন্দেহ, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, কঠিন ও জটিল দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, ব্যর্থ কামনার প্রতি প্রবল আকর্ষণ— ইত্যাদি মানুষের ঘুমের রেইম স্তরে স্বপ্নের মাধ্যমে বার বার ফিরে আসে। অনেক সময়ে সদ্য শেষ হওয়া কোনও কাজের অনুষঙ্গেও স্বপ্নে আসতে পারে। ফ্রয়েডের তত্ত্বে রয়েছে, অনেক সময়ে আমরা ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছুড়ি। কিন্তু ঘুম ভাঙলে স্বাভাবিক হয়ে যাই। ঘুমের সময়ে মস্তিষ্ক এবং শরীর বিশ্রামে থাকে। শরীর বিশ্রামে থাকলেও, যদি মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে তবে এই সব ঘটতে পারে। প্রত্যেক মানুষই কমবেশি স্বপ্ন দেখেন। তবে শিশুরা বেশি স্বপ্ন দেখে, কারণ তারা বেশি ঘুমোয়।
এঁদের তত্ত্ব প্রথম থেকেই বিতর্কিত। পরে মনোবিদ আইসেঙ্ক, ফ্রয়েডের পক্ষ সমর্থন করলেও ক্লাইমের মতো অনেক মনোবিদই ফ্রয়েডের এই মতের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের মতে, স্বপ্নে ভেসে আসা প্রতীকগুলির সঙ্গে যৌনতার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে সৃষ্টির জগতে স্বপ্নের ভূমিকা চিরন্তন। অনেক কবি, সাহিত্যিকের স্বপ্নে দেখা ঘটনা জন্ম দিয়েছে কালজয়ী সৃষ্টির। যেমন, কবি কোলরিজের ‘কুবলা খান’ কবিতার কথা বলা যেতে পারে। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের কথায় বলতে হয়, ‘‘স্বপ্ন হল সেই জিনিস, যা মানুষকে ঘুমোতে দেয় না। যতক্ষণ না তা বাস্তবায়িত হচ্ছে।’’
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy