সুগত বসু প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তাঁহার পরিবারকেই যদি সিন্ডিকেটের হাতে এতখানি হেনস্তা হইতে হয়, তবে সাধারণ লোকের কী দশা হইতেছে? প্রশ্নটি অলংকারমাত্র। কারণ, এই প্রশ্নের উত্তর পশ্চিমবঙ্গ বিলক্ষণ জানে। এই রাজ্যে আর কয় ঘরই বা সাংসদ-বিধায়ক-মন্ত্রী আছেন? অভিজ্ঞরা বলিবেন, বাকিদের জন্য পুলিশ নাই, প্রশাসনও নাই— আছে শুধু সিন্ডিকেটের দাদাদের ঔদ্ধত্য মানিয়া লইবার বাধ্যবাধকতা। বেশি মূল্য নিকৃষ্ট মানের নির্মাণ-সরঞ্জাম, তাহাও পরিমাণে কম, লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে হয়। নচেৎ, বাড়ি নির্মাণ বা মেরামত তো দূরের কথা, শান্তিতে বাঁচিবার উপায়টুকুও থাকে না। হাওয়ায় অভিযোগ ভাসিয়া আসে যে তাবড় নেতাদের ধরিলেও নিষ্কৃতি নাই— খানিক হইলেও অর্থমূল্যে শান্তি কিনিতে হয়। সিন্ডিকেট নামক ব্যবস্থাটির জন্ম ২০১১ সালের মে মাসের পর, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারাও এহেন অভিযোগ করিবেন না। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বহু পাপের ন্যায় ইহাও বাম আমলেরই ঐতিহ্য। কিন্তু, তৃণমূল কংগ্রেসের ছয় বৎসরে সিন্ডিকেটাসুরের দাপট তিলমাত্র কমে নাই। যদি কিছু কমিয়া থাকে, তাহার নাম কাণ্ডজ্ঞান। যে দাদারা প্রকাশ্যেই দাবি করিয়া থাকেন যে তাঁহারা শাসকদলের আশীর্বাদধন্য, বামফ্রন্ট আমলে তাঁহাদের এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান ছিল যে কোনও সাংসদের বাড়িতে চড়াও হইতে নাই। অথবা, চড়াও হইবার পূর্বে তাঁহারা খোঁজখবর লইতেন যে বাড়িটি কাহার। গত ছয় বৎসরে এই বিচারবুদ্ধিটি সম্পূর্ণ লোপ পাইয়াছে। ফলে, সাধারণ মানুষের যে দশা হয়, শাসক দলের সাংসদকেও সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে হইতেছে।
সিন্ডিকেটের সমস্যাটি বহু-আলোচিত, এবং সম্ভবত সমাধানের অতীত। তাহার কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘ক্লায়েন্টেলিজম’-এর অন্যতম প্রধান প্রকাশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই। এলগিন রোডে অধ্যাপক বসুর বাড়িতে সিন্ডিকেটের বাহুবলীদের চড়াও হওয়ার পিছনে যাঁহার নাম শোনা যাইতেছে, তাঁহার ন্যায় দাদা এখন পাড়ায় পাড়ায়। দুর্জনে বলিয়া থাকে, শাসক দলের সহিত এই দাদাদের সম্পর্ক অতি সরল— তাঁহারা দলের পরিচয় ব্যবহার করিয়া তোলাবাজি চালাইয়া যান, এবং পরিবর্তে দলকে অর্থ এবং লোকবল জোগাইয়া থাকেন। যে রাজ্যে শিল্প নাই, কর্মসংস্থানের সুযোগ নাই, টাকাপয়সাও তেমন নাই, সেখানে ‘তাজা ছেলে’দের হাতে রাখিতে হইলে এইটুকু ছাড় দিতে হয় বইকি। সিন্ডিকেট বন্ধ করিয়া সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার কোনও প্রণোদনা শাসক দলের নাই, কারণ ভোটবাক্সে প্রমাণ হইয়া গিয়াছে, জীবনের এই জাতীয় ছোট-বড় ওঠাপড়া রাজ্যবাসীর গায়ে লাগে না।
স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাজ্যবাসী প্রত্যাশা করিতে পারিতেন, এই জাতীয় বে-আইনি কারবার ঠেকাইতে পুলিশ-প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিবে। কিন্তু, তাহা ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতি’তে, পশ্চিমবঙ্গে— বা, বৃহত্তর অর্থে, ভারতে— নহে। পুলিশ যাহা করিয়া থাকে, তাহার নাম অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা। কোথাও কোনও রাজনৈতিক যোগাযোগ নাই, এমন কেহ পুলিশের দ্বারস্থ হইলে সম্ভবত মেজবাবু অবধিও যাইবার দরকার পড়ে না, হাবিলদাররাই তাঁহাদের ভাগাইয়া দেন। যাঁহাদের সামান্য ধরা-করা করিবার ক্ষমতা আছে, তাঁহাদের ক্ষেত্রে পুলিশ ‘মিটমাট’ করিয়া লইবার পরামর্শ দেয়— যেন, বাড়ি বানাইতে চাওয়া, এবং তোলাবাজি, এই দুইটি সমান গোত্রের অপরাধ। অভিযোগকারীর নাম সুগত বসু হইলে অবশ্য পুলিশের আর নড়িয়া না বসিবার উপায় থাকে না। তখন অভিযুক্তদের বাঁধিয়া আনা হয়। তবে, সন্দেহ হয়, তাহা তোলাবাজির অপরাধে নহে। শাসক দলের সাংসদকেও চিনিতে পারে নাই, ইহাই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়। নচেৎ, তোলাবাজি তো কতই হয়। হইয়াই থাকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy