ফের বিতর্কে পায়েল রোহতগি। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।
বিদ্যাসাগর যাইলেন, আসিলেন রামমোহন। দুর্বৃত্তের রোষে বিদ্যাসাগরের মস্তক ভূলুণ্ঠিত হইয়াছিল, এক দুর্বাকের কবলে পড়িয়া নবজাগরণের পুরোধাপুরুষের মাথাও কাটা যাইবার উপক্রম। ভারতবর্ষ স্তম্ভিত হইয়া দেখিল, ভারতপথিককে টুইটারে ভূষিত করা হইল ‘দেশদ্রোহী’, ‘ব্রিটিশদের চামচা’ অভিধায়। করিলেন অভিনেত্রী পায়েল রোহতগি, যাঁহার টুইটার অ্যাকাউন্টটির সম্পূর্ণ নাম ‘পায়েল রোহতগি এবং গোষ্ঠী— ভগবান রামের ভক্তেরা’। জোটবদ্ধ থাকিলে উগ্রতার মোড়কে মূর্খতাকে চাপা দেওয়া যায়, যাহা ইচ্ছা তাহা বলিয়াই পার পাওয়া কিছুমাত্র কঠিন নহে— বিশেষত ‘দেশভক্তিবাদ’-এর এই ধূমাচ্ছন্ন কালে। তাই পায়েল বলিতে পারিলেন, ব্রিটিশরা রামমোহনকে ব্যবহার করিয়াছে সতীদাহের বদনাম করিতে। ওই প্রথাটি কদাপি অমানবিক ও পশ্চাদপসারী প্রথা নহে, হিন্দু নারী মুঘল আক্রমণকারীর হাত হইতে বাঁচিবার লক্ষ্যে তাহা স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া লইয়াছিল। হিন্দু নারীর সতীত্ব রক্ষার পুণ্যব্রতটি আন্দোলন করিয়া তুলিয়া দিয়াছে যে, সে ‘রাম-মোহন’ হইবে কী রূপে, সে তো সাক্ষাৎ রাম ও রাষ্ট্রবিরোধী!
স্বাভাবিক ভাবেই বিতর্ক উঠিয়াছে। সহমত ও বিরুদ্ধমতাবলম্বীরা ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন সমাজমাধ্যমে। গণতন্ত্রে বহুমত প্রত্যাশিত, বিতর্ক ও প্রতিবাদও স্বাগত— তত ক্ষণই, যত ক্ষণ সেই মত বা অমতের কিছুমাত্র সারবত্তা থাকে। আমার মত প্রকাশ করিবার অধিকার আছে মানেই যুক্তি বুদ্ধি সাধারণ জ্ঞান এবং রুচিবোধ হাওয়ায় উড়াইয়া দিয়া যথেচ্ছ বলিতে পারি না। গণতন্ত্র বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বটে, সেই সঙ্গে কে বলিতেছে এবং কী বলিতেছে সেই দিকে দৃষ্টি রাখিবার গুরুদায়িত্বও প্রত্যেক নাগরিককে অর্পণ করিয়া থাকে। মানুষ মাত্রেই কিছু স্বাভাবিক প্রবণতা আছে, কেহ রাজনীতি ভাল বুঝেন, কেহ ক্রীড়াজগৎ লইয়া বিশ্লেষণ করিতে পারেন, কাহারও সহজাত প্রীতি সমর্পিত শিল্পে সাহিত্যে। রাজনীতিক সঙ্গীতের তানকর্তব লইয়া মন্তব্য করিতেই পারেন, অভিনেতারও ইতিহাস ও সমাজসংস্কার বিষয়ে মতদান কদাচ নিষিদ্ধ নহে। কোন বিষয়ে কাহার বলিবার অধিকার আছে, তাহা লইয়া এত কাল কোনও গোলযোগ হয় নাই। কাণ্ডজ্ঞান ও সৌজন্যবোধে মানুষ অনধিকার প্রবেশ করেন নাই বলিয়াই হয় নাই। সমাজমাধ্যম আসিয়া নাগরিকের মতপ্রকাশ করিবার স্বাধীনতাকে যদৃচ্ছাচারের রূপ দিয়াছে। নিতান্ত অনধিকারীও তাই ভাবিতেছেন, যাহা হউক কিছু একটা প্রচারের হাওয়ায় ভাসাইয়া দিই, দোষ কোথায়? রাজনীতি তথা দলতন্ত্রের রক্ষাকবচটি থাকিলে তো কথাই নাই, রক্ষী সমর্থকও জুটিয়া যাইবে। পায়েলের সমর্থনেও ভিড়িয়াছে অগণিত মানুষ। তাহাদের বক্তব্য, রামমোহনের সমগ্র জীবন ও কার্যই এক ঐতিহাসিক ব্যর্থতা।
অর্বাচীন মতকে নিজের চার দেওয়ালের ভিতর পুষিয়া রাখায় যত ক্ষতি, অভব্য তৎপরতায় তাহা চতুর্দিকে ছড়াইয়া দেওয়াটা ক্ষতি ডিঙাইয়া অপরাধের নামান্তর। মনে রাখিতে হইবে, প্রযুক্তিধন্য আধুনিক গণতন্ত্রে মতামত ও মন্তব্য মাত্রেই মুহূর্তে ছড়াইয়া পড়ে। তাহাতে তর্কের বীজ উপ্ত থাকিলে তো কথাই নাই, বিভেদ-বিদ্বেষের স্ফুলিঙ্গ থাকিলে অগ্নিকাণ্ড ঘটা সময়ের অপেক্ষামাত্র। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, মূর্খের মন্তব্য লইয়া কোন্দলে সমাজমাধ্যম বৃথা কালক্ষেপ করিতেছে, আর মন্তব্যকারী তখন পরবর্তী ফন্দি আঁটিতেছেন, প্রচারের যাবতীয় আলো এবং আত্মপ্রসাদটুকু শুষিবার কার্যে এই ক্ষণে তিনি যারপরনাই সফল। শুভবোধসম্পন্ন মানুষ যুক্তিপ্রমাণ দিয়া হিতাহিতজ্ঞানশূন্য পায়েলকে রামমোহন বিষয়ে তাঁহার মাত্রাজ্ঞান সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছেন। কিন্তু আপনার মতপ্রকাশের লক্ষ্মণরেখা এই অবধি বিস্তৃত বা সীমিত, এই কথা তাঁহাকে বলিবার জন্য কোনও রামভক্ত নিযুক্ত নাই, ইহাই দুঃখের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy