সারুবাই যে বাড়িতে কাজ করতেন, সুরযকে সেখানে কিছুতেই যেতে দিতেন না তিনি। এক দিন লুকিয়ে লুকিয়েই তাঁর পিছু পিছু সেখানে হাজির হল সে। ঢুকে দেখে, দিদিমা বাড়ির শৌচালয় সাফ করছেন। নাতিকে দেখে সারুবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন— কী কাজ করেন সেটা তাকে জানাতে চাননি তিনি। কিন্তু নাতি কেন বাধ্যতে। তো, একটু পরেই বালক জানাল, তার খুব বাথরুম পেয়েছে। প্রথমটায় তিনি বলে দিলেন, এখানে হবে না। তার পর নাতির করুণ মুখখানা দেখে মায়া হল, সন্তর্পণে তাকে যথাস্থানে নিয়ে গেলেন। বাড়ির ভিতরে নয়, তার কোনও প্রশ্নই নেই, বাইরের লোকজনের ব্যবহারের জন্য একটা শৌচালয় ছিল, এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন নাতিকে। এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সে। এবং দিদিমা জল ঢেলে বেরিয়েই দেখলেন— দরজার ও-ধার থেকে বাড়ির একটি মহিলা তাঁদের দেখছে। একটু পরেই বাড়ির মালকিনের কাছে ডাক পড়ল। যে সব গালাগালি তার শ্রীমুখ থেকে নিক্ষিপ্ত হল, তার অনেক শব্দই দশ বছরের সুরযের জানা ছিল না, কিন্তু তাতে তার আতঙ্ক আর অপমান এক ছটাকও কম হয়নি— ‘‘আমি সিঁটিয়ে গিয়ে মুখটা লুকোনোর চেষ্টা করছিলাম।’’ হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের শোরেনস্টাইন সেন্টার-এর গবেষক সুরয ইয়েংড়ে লিখেছেন, ‘‘এই ঘটনা আমাকে আমার দলিত সত্তাটি চিনিয়ে দিয়েছিল।’’ শিশু সে-দিনই বুঝে নিয়েছিল, তার স্থান উঁচু জাতের মলমূত্র ফেলার জায়গাটির চেয়েও নীচে।
মহারাষ্ট্রের নান্দেড়-এর দলিত পরিবারের সন্তান সুরযের বয়েস এখন একত্রিশ। দলিত-চর্চার ভুবনে তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্রুত। তাঁর লেখা কাস্ট ম্যাটারস (পেঙ্গুইন) আত্মজীবনী নয়, কিন্তু নিজের জীবনকে মন্থন করে রাজনীতি-ভাবনার দলিল। জ্ঞান হওয়ার মুহূর্ত থেকে সেই জীবন তাঁকে শিখিয়েছে যে তাঁর স্থান, তাঁর স্বজনবান্ধবের স্থান মহান ভারতের ত্রিশ কোটি অন্ত্যেবাসীর দুনিয়ায়, সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধ হওয়ার সাত দশক পরেও যারা উচ্চবর্ণের বহু মানুষের চোখে তাদের শৌচালয়ের থেকেও অশুচি। তিনি নিজের জীবনে সফল, কৃতবিদ্য। কিন্তু ব্যক্তিগত সাফল্য তাঁকে পরিতৃপ্ত করেনি, তাঁর চেতনাকে প্রখরতর করেছে। জ্ঞানচর্চা এবং জীবনচর্যার টানাপড়েনে তৈরি সুরযের সুতীক্ষ্ণ আত্মবোধ ঘোষণা করে: ‘‘আমি মানুষ নই, আমি দলিত। আমি সহকর্মী নই, আমি দলিত। আমি বন্ধু নই, আমি দলিত।’’ এই উচ্চারণের গভীরে আছে কয়েক হাজার বছরের নিপীড়ন। সেই ঐতিহ্য আজও সমানে চলেছে। হাথরসের দলিত জননী তাঁর যন্ত্রণাদীর্ণ কন্যার রক্তাক্ত নিম্নাঙ্গ ঢেকে দেওয়ার জন্য কাপড় খুঁজেছেন, তার কয়েক দিন পরে সেই কন্যার মৃতদেহ পুলিশের হেফাজতে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, মা একটি বার মেয়ের মরা-মুখও দেখতে পাননি।
হাথরসের ঘটনা পৈশাচিক, কিন্তু অকল্পনীয় তো নয়ই, অভাবনীয়ও নয়, বরং এমন আরও অনেক পৈশাচিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যে সমাজে ক্রমাগত এই পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, হিংসা তার মজ্জায় মজ্জায়। হিংসার উৎকট প্রকাশ দেখে আমরা (কখনও কখনও) শিহরিত হই, কিন্তু ভিতরের রূপটি খেয়ালও করি না। অথচ খেয়াল করলেই ধরা পড়ে, প্রকৃত গরল কোন আধারে সঞ্চিত।