Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সংখ্যাগুরুবাদ নিয়ে উদ্বেগ আছে, কিন্তু সম্ভাবনাও কম নয়

নতুন এক জাতীয় সংলাপ

দেশের এক বড় অংশের শহর ও শহরতলির হাটেবাজারে বা গ্রামের রাস্তাঘাটে ছবিটা একেবারে অন্য রকম। বৃহস্পতিবার, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের গোধূলিতে ভারতবর্ষের বহু মানুষের মুখে ছিল পরম তৃপ্তির হাসি।

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল শুনে ভারতের লিবারাল এবং প্রধানত সচ্ছলদের বেশির ভাগের মুখ হাঁড়ি হয়ে গিয়েছে। অনেকেই ফেসবুকে লিখেছেন তাঁরা এই ভারতে বাস করতে চান না। অন্য অনেকের আশঙ্কা, সামনে ঘোর বিপদ। ভারতের একটা অংশের চোখেমুখে গভীর আতঙ্ক ও হতাশার অন্ধকার।

দেশের এক বড় অংশের শহর ও শহরতলির হাটেবাজারে বা গ্রামের রাস্তাঘাটে ছবিটা একেবারে অন্য রকম। বৃহস্পতিবার, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের গোধূলিতে ভারতবর্ষের বহু মানুষের মুখে ছিল পরম তৃপ্তির হাসি। তাঁরা ইভিএমে নীরব প্রত্যয়ে নিজের মত জানিয়েছিলেন, সমাজমাধ্যমের জ্ঞানের বাণী জানার দরকার হয়নি তাঁদের, কান দিতে হয়নি রাজনীতিকদের বড় বড় কথায়।

এই নির্বাচনে দেশের মধ্যে কোনও একটি বিষয়ে যদি ঐকমত্য থেকে থাকে, তা হল, ভারতের এক জন বিশ্বাসযোগ্য, প্রত্যয়ী নেতা দরকার যিনি দৃঢ় ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অস্থিরমতি প্রাদেশিক নেত্রী, জাতপাতের রাজনীতির নায়ক, অতীত হয়ে যাওয়া পরিবারের উত্তরাধিকারী— এ সবই দেশের মানুষের কাছে এখন অচল। তাঁরা মনে করেছেন, এক জনই তাঁদের চাহিদা মেটাতে পারেন। নরেন্দ্র মোদী।

প্রায় আট কোটি কুড়ি লাখ ভারতবাসী এ বার প্রথম ভোটাধিকার পেয়েছেন— মোট ভোটার সংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ। মোদীর বিপুল জয়ের পিছনে তাঁদের ভোট সম্ভবত এক বড় ভূমিকা নিয়েছে। মোদী ক্ষমতায় ফিরবেন, সেটা বেশির ভাগ নির্বাচন-বিশারদই ভেবেছিলেন, কিন্তু তাঁদের ধারণা ছিল তিনি বেশ কিছুটা ধাক্কা খাবেন। তেমন কিছুই ঘটেনি। সব অতিনাটক, গুহার মধ্যে ফটো সেশন এবং নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের নানা অভিযোগ সত্ত্বেও মোদী সব পূর্বাভাসের চেয়েও ভাল ফল করেছেন।

নবীন ও তরুণ ভারতীয় ভোটদাতার কাছে রাজনৈতিক সূক্ষ্মতা বা আদর্শবাদের কোনও দাম নেই। এই বাস্তববাদী প্রজন্ম এমন এক নেতাকে চান, যিনি বিভিন্ন বাধা অতিক্রম করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই নির্বাচনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বার্তাটি সম্ভবত এই যে, নতুন ভোটদাতারা মায়াবতী বা অখিলেশ যাদবদের জাতপাতের রাজনীতিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নানা ভুলভ্রান্তি ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও এসপি-বিএসপি জোট তাঁদের প্রত্যাশার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। গুজরাতের পটেল-রাজনীতিও ব্যর্থ। স্পষ্টতই, জাতপাতের রাজনীতি সম্পর্কে ভারতীয় ভোটারের ধারণায় মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে। উত্তর ভারতের রাজনীতির ভবিষ্যতের উপর এর বড় রকমের প্রভাব পড়বে।

বরং অনেকেই এখনও কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ এবং মোটের উপর জাতপাতের বাইরে থাকা রাজনীতিকে একটা সুযোগ দিতে রাজি, কিন্তু একটা জৌলুস-হারানো, ব্যর্থ-প্রমাণিত পরিবারের আঁচলে এখনও নিজেকে শক্ত করে বেঁধে রাখার ফলে সেই সুযোগও নষ্ট হচ্ছে। এখনও অনেক দিন বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস কিছুটা গুরুত্ব ধরে রাখতে পারবে, কিন্তু পরিবারতন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করতে না পারলে তারা মাঝমাঠে ফিরতে পারবে না।

নরেন্দ্র মোদী এই ফলাফলকে কী ভাবে বিচার করবেন, আগামী পাঁচ বছরের প্রশাসনের চরিত্র তার উপর অনেকাংশে নির্ভর করছে। তিনি যদি ভাবেন, এই জয়ের মানে হল এই যে, সমস্ত বিষয়ে তাঁর সব সিদ্ধান্তই নির্ভুল, ভোটদাতারা তাঁর অসামান্য প্রশাসনিক দক্ষতায় অভিভূত হয়েই তাঁকে এমন সমর্থন করেছেন, তবে দেশের সামনে সমূহ বিপদ। এক দিকে, অর্থনীতির বহু সমস্যার মোকাবিলা করতে এবং ব্যাহত উন্নয়নের গতি ফিরিয়ে আনতে যে সব মৌলিক পরিবর্তন ও সাহসী সংস্কার জরুরি, পরের পাঁচ বছরেও সেগুলি ঠিক ভাবে করা হবে না। অন্য দিকে, নেতা যদি মনে করেন তিনি কখনও কোনও ভুল করতে পারেন না, দেশকে সেই বিপুল অহঙ্কারের মাসুল গুনতে হবে, নোট বাতিলের মতো আরও নানা বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকবে, হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীদের শাসনে আনার সম্ভাবনা কমবে।

কিন্তু মোদী যদি এটা বুঝতে পারেন যে, নানা ত্রুটি সত্ত্বেও দেশবাসী তাঁকে কাজ করে দেখানোর আর একটা সুযোগ দিয়েছেন, তবে হয়তো কিছু উন্নতি দেখতে পাব আমরা। এই মুহূর্তে দেশের দুটো প্রধান সমস্যা: অর্থনীতির দুর্দশা এবং সামরিক বাহিনীর, বিশেষত বিমানবাহিনীর করুণ অবস্থা। অন্য দিকে, বিশ্বের পরিস্থিতি এখন ভারতের পক্ষে অনেকটা অনুকূল, কারণ পাকিস্তান গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত, চিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নীতির লড়াইয়ে ব্যতিব্যস্ত এবং সন্ত্রাসের প্রশ্নে দুনিয়া অনেক বেশি কঠোর, আপসহীন।

পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হানা ও তার পর বালাকোটে বোমাবর্ষণকে নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে যে ভাবে ব্যবহার করেছেন, তা বেপরোয়া এবং কুরুচিকর। কিন্তু তাঁর এই প্রচার সফল হয়েছে। স্বভাবতই ধরে নেওয়া যায়, জাতীয় নিরাপত্তার উপর জোর দেওয়া হবেই, এবং এ বিষয়ে উগ্র আচরণ উগ্রতর হতেই পারে। পাকিস্তান বা কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ হয়তো কমবে, পুলওয়ামার মতো ঘটনার জবাব তীব্রতর হবে।

নরেন্দ্র মোদীর সাফল্যের পিছনে ভারতের গরিব মানুষের ভোটের অবদানও বিস্তর। জন ধন, শৌচাগার, স্বাস্থ্য বিমা, উজ্জ্বলা ইত্যাদি প্রকল্প অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট কার্যকর হয়নি, কিন্তু মানুষ এগুলি দেখে মনে করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের জন্য অনেক কিছু করতে চান, দলের ভিতরে নানা দ্বন্দ্ব ও সমস্যার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি গরিবের মঙ্গল সাধনের চেষ্টা করছেন। পরবর্তী সরকার যদি এই প্রকল্পগুলিকে সুগঠিত করে এবং দুর্নীতি ও অপচয় দূর করে এগুলিকে আরও কার্যকর করে তুলতে তৎপর হয়, তবে দেশের মঙ্গল হবে।

অন্য দিকে, ঋণের ভারে কাবু কর্পোরেট সংস্থার পুনরুজ্জীবন, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার স্বাস্থ্যোদ্ধার, দেউলিয়া আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলার নিষ্পত্তি, আইএলঅ্যান্ডএফএস-এর মতো কেলেঙ্কারি বা বিপর্যয় প্রতিরোধ, ইত্যাদি বিষয়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকার পাঁচ বছরে কোনও কাজের কাজ করে বা ভেবে উঠতে পারেনি। এটা খুব বড় ত্রুটি। বিশ্ব অর্থনীতিতেও গতিভঙ্গের লক্ষণ স্পষ্ট। বিশেষত দুই অর্থনৈতিক মহাশক্তি চিন ও আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে ভারতের উন্নয়নের পথ আরও দুর্গম হতে পারে। সেই সঙ্কটের মোকাবিলায় সরকারকে আর্থিক সংস্কারের, এবং তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের কাজে আরও অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। এই ফলাফল সে বিষয়ে বিশেষ আশা জাগায় না।

সব কিছু ছাপিয়ে এই ফল একটা সঙ্কেত দেয়: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলিতে দেশবাসীর একটা বড় অংশ একই ভাবে ভাবছেন। লক্ষ করার বিষয়, নরেন্দ্র মোদী দেশে বিভাজন বাড়িয়েছেন— এ অভিযোগের সঙ্গে সঙ্কেতটি মেলে না। আসলে, সেই ১৯৪৭ থেকেই ভারতে বিভাজন ছিল এবং আছে। ভারত হাজার মতবিরোধ, লক্ষ বিদ্রোহের দেশ, সে কথা ভি এস নইপল বলেছিলেন অনেক দিন আগেই। সেই অগণিত বিভাজন ও বিভেদ নিয়েই এই দেশ টিকে আছে, টুকরো হয়ে যায়নি, বরং তার অগ্রগতি বাকি দুনিয়াকে অবাক করে দিয়েছে। যেটা সম্ভবত নতুন, তা হল জাতীয় সংলাপের এক সমান্তরাল ধারা, যে ধারা জাতীয় ঐক্যের সন্ধান করে, একটা অভিন্ন পরিণতি চায়। এই আকাঙ্ক্ষা হয়তো নবীন এবং তরুণ ভারতবাসীর অবদান। আমরা দেখছি নতুন এক উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে, যারা নিজের নিজের জীবনে সমৃদ্ধি চায়, সম্মান চায়। সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ যে সব রাজনৈতিক আদর্শবাদ বা নানা উচ্চাঙ্গের তত্ত্বের কথা বলেন, এঁরা তা নিয়ে একটুও মাথা ঘামান না। এই জনতাকে দেখে লিবারাল এবং তুলনায় সচ্ছল ভারতীয় নাগরিকরা হতাশা বোধ করতে পারেন। কিন্তু এটাই বাস্তব।

এই নির্বাচনের ফলাফল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলতে পারে, এমন আশঙ্কা স্বাভাবিক। এটা সত্যিই গুরুতর প্রশ্ন। সংখ্যাগুরুর দাপট সব সময়েই বড় রকমের ভয়ের কারণ। এই দাপট নিয়ন্ত্রণে না রাখলে তা জাতীয় ঐক্যের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা কেবল এইটুকুই আশা করতে পারি যে, অসহিষ্ণুতা, অন্ধবিশ্বাস এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সতর্ক করার মতো মানুষের অভাব হবে না, তাঁরা সজাগ ও সবাক থাকবেন। ভারতের সহাবস্থান এবং সমন্বয়ের ঐতিহ্যের কথা সংখ্যাগুরুদের ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে যেতে হবে। তা না হলে ভারতের স্থান হতে পারে নর্দমায়।

তবু বলতেই হবে, জাতীয় সংলাপের বিস্তর উত্তাপ, ধুলোবালি এবং গালিগালাজের নীচে ভারত জেগে উঠছে। তার চাকা ঘুরছে। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী সেই বিশাল চক্রের একটি নাটবল্টু মাত্র। আগামী বছরগুলিতে এই আবর্তনের গতি বাড়বে, বেড়ে চলবে। ভারতকে তা এমন জায়গায় পৌঁছে দেবে, এখনকার নেতারা যা ভাবতেও পারছেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE