Advertisement
০৭ মে ২০২৪
আপনার অভিমত
national language

বহুভাষিক রাষ্ট্রে একমাত্র ভাষা রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর হতে পারে না

সতেরোটি ভাষাকে আড়ালে রেখে হিন্দিকে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বানানোর এই যে মাতামাতি, তা আসলে রাজনৈতিক কূটকৌশল। আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এ বাঙালি তার মায়ের মুখ দেখুক ঘরের আলোয়। লিখছেন দেবাশিস ভৌমিকসংবিধানের নিয়ম মোতাবেক দেবনাগরী হরফে হিন্দি হবে সরকারি কাজকর্মের ভাষা। আর ইংরেজি কাজ করবে তার সাহায্যকারী ভাষা হিসাবে। তবে তার মেয়াদ মাত্র দেড় দশক। অথচ, সংবিধান নির্ধারিত সেই পনেরো বছর কেটে গিয়েছে কত যুগ আগেই।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৫৮
Share: Save:

যে কোনও গণতান্ত্রিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রকাঠামোয় রাজভাষা বা রাষ্ট্রভাষা শব্দবন্ধ একটু যেন কানে লাগে। সোনার পাথরবাটি আবার হয় নাকি! এক জাতি, এক ভাষা, এক রাষ্ট্র, এই ধরনের সরলরৈখিক উপাদান দিয়ে ভারতের শরীর গড়ে ওঠেনি। ফলে, হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর মতলবটা নেহাত একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার। কতটা ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো আর কী।

অনেক দিন আগে দুর্গাদাস বসুর একটি বইয়ে সংবিধানে উল্লিখিত ভারতীয় ভাষা প্রসঙ্গে একটি লেখা বেরিয়েছিল। বইটির নাম ‘ইনট্রোডাকশন্ টু দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া’। সেখানে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন— The Official Language of the Union shall be Hindi in Devnagari Scripts, but for a period of fifteen years from the commencement of the constituation, the English language shall continue to be used for all the official perposes of the union for which it was being used immediately before such commencement. [19th Ed.2001, p 397]।

তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াল, সংবিধানের নিয়ম মোতাবেক দেবনাগরী হরফে হিন্দি হবে সরকারি কাজকর্মের ভাষা। আর ইংরেজি কাজ করবে তার সাহায্যকারী ভাষা হিসাবে। তবে তার মেয়াদ মাত্র দেড় দশক। অথচ, সংবিধান নির্ধারিত সেই পনেরো বছর কেটে গিয়েছে কত যুগ আগেই। দিন যত গড়িয়েছে ইংরেজি জাঁকিয়ে বসেছে তার মৌরসিপাট্টা, ভারতবাসীর দৈনন্দিন কৃত্যের দায়রায়। তা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোথাও টু শব্দটিও শোনা যায় না। অন্য দিকে, হিন্দি যে বাধ্যতামূলক ভাবে সব রাজ্যে প্রত্যেককে আবশ্যিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে, প্রকাশ্যে সে কথা বলেও সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ। যা চলছে তা একটা চোরাবালির স্রোত। এ যেন এক গজকচ্ছপের লড়াই। সেখানে বাংলা ভাষার অবস্থানটা ঠিক কোথায়, তা খুঁঁজে দেখার প্রয়োজন আছে বইকি।

সংবিধানের অষ্টম তপসিলে সরকারি কাজকর্মের ক্ষেত্রে যে আঠেরোটি ভাষাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছিল, বাংলা ছিল তার মধ্যে অন্যতম। সেখানে কোথাও ইংরেজি ভাষার কোনও উল্লেখ নেই। এই আঠেরোটি ভাষাই সংবিধানস্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা। বাকি সতেরোটি ভাষাকে আড়ালে রেখে তবু কেন যে হিন্দিকে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা বানানোর এই মাতামাতি, তার শিকড় ঢুকে রয়েছে চোখের আড়ালে। এককথায় এটা রাজনৈতিক কূটকৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয়। মেনে নিতে অসুবিধে নেই, অন্য ভারতীয় ভাষাগুলির তুলনায় সারা ভারতে হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বেশি। এই অজুহাত হাতিয়ার করে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে চালানোর কুমতলব অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। এই চেষ্টা অচিরেই সাফল্য পাবে ভেবে আত্মবিশ্বাসী অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুরও তুলতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা আদৌ বুঝতে চাননি যে বহুভাষিক রাষ্ট্রে কিছুতেই একটি মাত্র ভাষা রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে না। ভাষার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ধারা একরৈখিক নয়। মুড়ি-মিছরি একদর হয় নাকি?

ফলে ঘুরপথে রাজনৈতিক কৌশল কাজে লাগানোর শলাপরামর্শ শুরু হল। দৃশ্যমাধ্যম বিশেষত দূরদর্শনের হাজারো চ্যানেলে অবিরত চলতে থাকল হিন্দি ভাষার মাধ্যমে বিনোদনের হরেক কিসিম। প্রত্যক্ষ না হলেও এর পরোক্ষ প্রভাব সব রাজ্যেই কম বেশি পড়েছে। বিশেষ করে, বঙ্গবাসীর আটপৌরে কথ্যভাষাচর্চায় হিন্দির প্রভাব আজ অত্যন্ত সুলভশ্রুত। হিন্দিভাষার প্রচার অবিরাম চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন ভাবলে ভুল হবে। এর পিছনে রয়েছে একটা বাণিজ্যিক স্বার্থও। বাজারি পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে নির্দিষ্ট একটি ভাষাকে ব্যবহার করতে পারলে অনেকটাই খরচ বাঁচানো যায়। আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটি রাজ্যের ভাষায় বিজ্ঞাপন তৈরির হ্যাপা তো কম নয়। তাই প্রচারমাধ্যমে অবিরাম হিন্দিভাষার দাপটকে বাঁচিয়ে রাখার গোপন কৌশল আজও একই ভাবে জারি রয়েছে। অনেকটা জোর করে ঢেঁকি গেলানোর মতো।

হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষা মানেই তা আঞ্চলিক ভাষা, এই ধরনের প্রচার অবিরাম চালিয়ে যাওয়া একরকম কারচুপি। একটু দেরিতে হলেও বাঙালি তা আজ কিছুটা বুঝতে পেরেছে। নিজের ভাষা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবাসী আজ এই ভেবে অনেকটাই গর্বিত যে, আন্তর্জাতিক স্তরে হিন্দির চেয়ে বাংলার গুরুত্ব অনেক বেশি। সেখানে বাঙালি তাঁর সম্মানের জায়গা তৈরি করেছে স্বীয় কৃতিতে। সাহিত্যে নোবেলপ্রাপক রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রের অস্কার পর্যন্ত তার আয়ত্তে। এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পাবার প্রেক্ষাপটও বাংলাভাষা। শুধু বাংলা কেন, উর্দু, তামিল, মারাঠি, যে কোনও ভাষার তুলনায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিন্দিভাষা অনেক কম গুরুত্ব বহন করে। তাই বঙ্গভাষার বৈভবপ্রাসাদে কিংবা উদাস মেদুর প্রান্তরে হিন্দিভাষার বীজরোপণে যে সারই প্রয়োগ করা হোক না কেন, তা কিছুতেই সুফসলি হবে না। মাঝে মাঝে আগাছার জঙ্গল আমাদেরই সাফ করে নিতে হবে।

বাংলা সরকারি মান্যতা পেলেও তাকে ঠিকঠাক আজও ঘরের লক্ষ্মী করে তোলা যায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের আবেদনপত্র আজও ইংরেজি কিংবা হিন্দি ছাড়া তেমন একটা হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী ভাষা হিসেবে বাংলা আজও সমাদৃত নয়। একদিন রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল— ‘‘রাষ্ট্রিক কাজের সুবিধা করা চাই বইকি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সরস সফল ও সমুজ্জ্বল করা। সে কাজ আপন ভাষা নইলে হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারী প্রদীপ জ্বালানো চলে, কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না।’’ বেদনার কথা, আজও কবিকে সে আক্ষেপ থেকে মুক্ত করতে পারিনি।

আজ সন্তানকে ইংরেজি ভাষাশিক্ষায় সড়গড় করে তোলার জন্য রাত্রি জেগে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের আবেদনপত্র সংগ্রহ করার কৃচ্ছ্রতা পালন করছেন অভিভাবক। নাওয়াখাওয়া ভুলে নিজেকে ‘গ্রুম’ করছেন 'ইন্টারভিউ’য়ে সফল হওয়ার জন্য। অথচ, সেই সন্তানকে ইতিহাস শেখানোর জন্য একবারের জন্যও নিয়ে যাচ্ছেন না ভারতের ঐতিহাসিক সৌধগুলিতে। ভূগোল চেনাতে একবারও ভাবছেন না কচ্ছের রণ কিংবা সমুদ্র দেখানোর কথা। মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা শেখাতে কখনও তার জন্মদিনে হাতে তুলে দিচ্ছেন না বাংলা সাহিত্যের বই। ইংরেজি যে শুধুমাত্র একটি কথ্য বা লেখ্য মাধ্যম, এই সরল সত্যের চোখে ঠুলি পরিয়ে গর্বিত অভিভাবক আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। বঙ্গবাসীর জীবনে এ এক অদ্ভুত বিপন্ন বিস্ময়।

বাংলা ভাষার প্রতি এ উদাসীনতা আর বাড়তে দেওয়া চলে না। যাঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাও কি গভীর ভাবে ভাবছেন সমস্যাটির কথা! এ রবীন্দ্রভাষ্য তো তাঁরা শ্রেণিকক্ষে বারবার উচ্চারণ করেন, ‘‘বিশেষ কাজের প্রয়োজনে কোনো বিশেষ ভাষাকে কৃত্রিম উপায়ে স্বীকার করা চলে, যেমন আমরা ইংরেজি ভাষাকে স্বীকার করেছি। কিন্তু ভাষার একটা অকৃত্রিম প্রয়োজন আছে। সে প্রয়োজন কোনো কাজ চালাবার জন্য নয়, আত্মপ্রকাশের জন্য।’’ অথচ বিদ্বৎমহলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সেমিনার বা আলোচনা চক্রে একঘর বাঙালি শ্রোতার সামনে একজন বঙ্গভাষী বক্তা অনভ্যস্ত ইংরেজি উচ্চারণে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। ফলে সামনের শ্রোতা ভাষার প্রতি যতটা মনোযোগী থাকছেন, বিষয়ের প্রতি ততটা নন। আত্মপ্রকাশের এই পঙ্গুত্ব থেকে বাঙালিকে বেরোতেই হবে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে দেউড়ির আলোয় নয়, বাঙালি তার মায়ের মুখ দেখুক ঘরের আলোয়। বাংলার মতো এমন সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পৃথিবীর যে কোনও দেশের সঙ্গে আমরা পাল্লা দিয়ে প্রথম স্থানে উঠে আসতে পারি, এই আত্মপ্রত্যয় বাঙালির নিজস্ব সম্পদ।

লেখক: কালিয়াগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE