চিকিৎসার এক অভূতপূর্ব সংকট দেখা দিয়াছে। এক দিকে বিরল, দুরারোগ্য রোগ নিরাময় করিবার উপায় আয়ত্তে আসিতেছে, অপর দিকে পরিচিত, সাধারণ রোগগুলি দুরারোগ্য হইয়া উঠিতেছে। কারণ, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি মানবদেহের প্রতিরোধ গড়িয়া উঠিতেছে। এই বিপদ নূতন নহে। কিন্তু তাহা কত দূর ভয়ানক হইয়া উঠিয়াছে, সম্প্রতি ফের তাহার ইঙ্গিত মিলিল। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলিয়াছে, ২০৩০ সালের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া (কে নিউমোনিয়া) এবং ই কোলাইয়ের অধিকাংশ সংক্রমণ সারাইতে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যর্থ হইবে ভারতে। এই দুই জীবাণু সাধারণ সংক্রমণ হইতে প্রাণঘাতী অসুখ, সকলই সৃষ্টি করিয়া থাকে। পরিচিত ঔষধে প্রতিরোধ করিতে না পারিলে হাসপাতালে দীর্ঘ দিন থাকিতে হইবে, চিকিৎসার খরচ বাড়িবে, মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়িবে। চিকিৎসকেরা সাধারণ অসুখেও তীব্রতম ঔষধ প্রয়োগে বাধ্য হইবেন, ফলে সেইগুলিতেও প্রতিরোধ জন্মাইবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আন্দাজ, ২০৫০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষের মৃত্যু হইবে ঔষধের নিষ্ফলতায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই জীবাণু নিজেকে পরিবর্তন করে। অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন করিলে তাহার প্রতিরোধকারী জীবাণু উৎপন্ন হওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধক অতিজীবাণু বা সুপারবাগের আঁতুড়ঘর বলিয়া ভারতের স্বীকৃতি জুটিয়াছে বিশ্বে।
২০১০ সালেই স্পষ্ট, মাথাপিছু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে ভারত বিশ্বের শীর্ষে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ-বিষয়ে বারংবার সতর্ক করিয়াছে। যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় এবং ঔষধ খাইবার নির্দেশ অমান্য করা, এই দুইটি কারণে বিশ্বের গড়ের চাইতে অনেক দ্রুত প্রতিরোধ বাড়িতেছে ভারতে। চিকিৎসকেরা যে অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক লিখিয়া থাকেন, তাহাও প্রমাণিত। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ চিকিৎসকদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিধিনিয়ম প্রকাশ করিয়াছে। নানা সময়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রেসক্রিপশনের উপর নজরদারির প্রস্তাবও উঠিয়াছে। কিন্তু কেহই কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে নাই। কারণ কেবল ঔষধ প্রস্তুতকারকদের উৎকোচ কিংবা সরকারি কর্তাদের গাফিলতি নহে। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করিতে গেলে বাস্তবিক প্রয়োজনেও ঔষধ না পাইবার সম্ভাবনা।
ভারতের উভয়সংকট। ঔষধের অতিব্যবহার এবং অব্যবহার পাশাপাশি বহিয়া চলিতেছে এ-দেশে। সমীক্ষাতেই প্রকাশ, ঔষধ-প্রতিরোধক জীবাণুর সংক্রমণে ভারতে যত শিশুর মৃত্যু হয়, তাহার অধিক মৃত্যু হয় যথাযথ অ্যান্টিবায়োটিক পাইবার কিংবা কিনিবার ক্ষমতার অভাবে। অতএব নিয়ন্ত্রণের উপরেও নিয়ন্ত্রণ রাখিতে হইবে। সম্ভবত সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন অসুখের আশঙ্কায় ঔষধের প্রয়োগের উপর। এই কারণেই পশুপাখির খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ ব্যবহার হইতেছে, যাহা মানুষের শরীরেও প্রতিরোধ জন্মাইতেছে। নবজাতক শিশুদের শরীরেও অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করিতেছে না। সামান্যতম ঝুঁকি না লইবার মানসিকতা থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের অবাধ ব্যবহার হইতেছে। তাহা যে অলক্ষ্যে আরও ভয়ানক ঝুঁকি তৈরি করিয়া চলিতেছে, তাহা কে বুঝাইবে? অনাগত প্রজন্মকে নিষ্ক্রিয় ঔষধ, নিরুপায় চিকিৎসকের সম্মুখে ফেলিয়া যাওয়াই কি আমাদের কর্তব্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy