Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কিউবার সমাজতন্ত্র তার নিজের মতো

ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে অনেক কথা গত দু’দিনে নতুন করে বলা হয়েছে। তাঁর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং রোমাঞ্চকর। বস্তুত, পঞ্চাশটা রহস্যরোমাঞ্চ ছবি একসঙ্গে করলেও ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনটাকে পুরোপুরি ধরা যাবে না।

অঞ্জন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে অনেক কথা গত দু’দিনে নতুন করে বলা হয়েছে। তাঁর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং রোমাঞ্চকর। বস্তুত, পঞ্চাশটা রহস্যরোমাঞ্চ ছবি একসঙ্গে করলেও ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনটাকে পুরোপুরি ধরা যাবে না। তাই সে দিকে না গিয়ে বরং কিউবায় এবং বিশ্বে তাঁর গুরুত্বটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

সার্বভৌমত্ব, বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র

ফিদেলের চিন্তা ও কাজের কেন্দ্রে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হল জাতীয় সার্বভৌমত্ব। তিনি যে এক সময় সমাজতন্ত্রের পথ নিয়েছিলেন, সেটাও বুঝতে হবে বাতিস্তার বিরুদ্ধে কিউবার সার্বভৌমত্ব অর্জনের সংগ্রামের প্রেক্ষিতেই। বাতিস্তা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল। ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব সেই পুতুল-সরকারকে উৎখাত করে, তার লোকজন মায়ামিতে পালিয়ে গিয়ে প্রধান বিরোধী ঘাঁটি তৈরি করে। বিপ্লবের আগে কিউবার রাজনীতি ও সরকারি নীতি ছিল আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে, জমির মালিক ছিল ভূস্বামীরা ও মার্কিন কোম্পানিগুলি, নানা পণ্য হয় আমেরিকা থেকে আমদানি হত অথবা কিউবায় আমেরিকান কোম্পানি তৈরি করত, দারিদ্রের মাত্রা ছিল অস্বাভাবিক বেশি, নিরক্ষরতা ও অস্বাস্থ্য ছিল ব্যাপক, জাতি-বৈষম্য, বিশেষ করে আফ্রিকা থেকে আসা ক্রীতদাসদের বংশধরদের নিপীড়ন একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছিল, যে কোনও প্রতিবাদ ছিল নিষিদ্ধ, যে কোনও বিরোধিতা কঠোর ভাবে দমন করা হত।

ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর লড়াই শুরু করেছিলেন, কমিউনিস্ট নয়, বাম জাতীয়তাবাদী হিসেবে। স্বভাবতই তিনি মনে করতেন, জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব হল প্রথম কথা, তাকে বাদ দিয়ে নতুন কিউবা নির্মাণ অসম্ভব। এই আদর্শই মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে আজ অবধি কিউবার আপসহীন অবস্থানের মূলে। কিউবা যে আন্তর্জাতিক সংহতিকে বরাবর গুরুত্ব দিয়েছে, তারও ভিত্তিতে ছিল বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান।

কিউবার বিপ্লবের পরে আমেরিকা দেখে, তার প্রভাব খর্ব হচ্ছে। কাস্ত্রোর সরকারকে উৎখাত করতে উঠেপড়ে লাগে তারা, এক সময় ছোট্ট প্রতিবেশী দেশটির উপরে নির্মম অবরোধ জারি করে। সিআইএ-র উদ্যোগে বহু বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা হয়। ফিদেল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকে বলেছিলেন, ‘আততায়ীর আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়াটা যদি অলিম্পিকের খেলা হিসেবে স্বীকৃত হত, তবে আমি স্বর্ণপদক পেতাম।’ কিউবার উপর অবরোধ ও (১৯৬১ সালে মার্কিন ব্যবস্থাপনায়) আক্রমণের আসল নিশানা ছিল তার সার্বভৌমত্ব। এই প্রেক্ষিতেই ফিদেল একমাত্র কার্যকর বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্রের পথ বেছে নিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের হাত ধরলেন, যদিও সেই সমাজতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করলেন কিউবার নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী।

একদলীয় শাসন এবং বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের কারণে কাস্ত্রো সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিপ্লবের ভিতটা অক্ষত রাখার জন্য এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল, যে ভিতের উপর গড়ে উঠেছিল সার্বভৌমত্ব, জাতি-বৈষম্যের সম্পূর্ণ অবসান, ভূমি সংস্কার, সর্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, দারিদ্র দূরীকরণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি, খেলাধুলার প্রসার এবং শিল্পায়ন। ঠিক হোক বা ভুল হোক, কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি (১৯৬৫ সালে যার জন্ম) মনে করে, এই নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের ছোট্ট দেশটির পক্ষে সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধন করা ও ধরে রাখা সম্ভব নয়।

ধনতন্ত্রের মতোই সমাজতন্ত্রও অনেক ধরনের হতে পারে। কিউবার সমাজতন্ত্রও তার নিজের মতো। তার কাঠামোটা উপর থেকে বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, তা নিজের অন্দর থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এখনও হচ্ছে। এবং এই কারণেই ফিদেল ও তাঁর কিউবা ভয়ঙ্কর আর্থিক অবরোধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন সামলে এগারো জন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পার করেছে। কিউবার সমাজতন্ত্রের সাফল্যের মূলে আছে তার জনসাধারণের অন্তর্নিহিত শক্তি।

আন্তর্জাতিকতা ও সংহতি

দৃশ্য ১: ২০১৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ফিরে এল ইবোলা। মহামারীতে এগারো হাজারের বেশি প্রাণ গেল। চার দিকে প্রবল আশঙ্কা— বৃহত্তর দুনিয়ায় এই কালান্তক রোগ ছড়িয়ে পড়বে। পশ্চিম দুনিয়ার আতঙ্কিত দেশগুলি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আবেদন জানাল, নিজেরা অবশ্য বিশেষ কিছু করল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০০০ সৈন্য পাঠাল, যদিও ঠিক কী কারণে বোঝা গেল না। এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের দেশ কিউবা তৈরি করল হেনরি রিভ ব্রিগেড, মহামারীতে আক্রান্ত দেশগুলিতে পাঠিয়ে দিল ৪৬১ জন ডাক্তার ও নার্সকে, বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে ইবোলার মোকাবিলায় নামলেন তাঁরা, অসংখ্য প্রাণ বাঁচালেন, অন্য দেশে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আটকাতে তৎপর হলেন। ডব্লিউএইচও তো বটেই, এমনকী চিরশত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইবোলার মোকাবিলায় কিউবার এই ভূমিকার প্রশংসা করল। হেনরি রিভ ব্রিগেডকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হল। পুরস্কার অবশ্য তারা পেল না— কেন, সেটা বলাই বাহুল্য।

বিপ্লব-উত্তর কিউবার স্বাস্থ্য পরিষেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা সুপ্রসিদ্ধ, যার রূপকার ছিলেন এর্নেস্তো চে গেভারা। তার অনন্যতা এই যে, নিজের জ্ঞান, মানবসম্পদ ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে কিউবা সব সময় আগ্রহী ও তৎপর। এখানেই তার আন্তর্জাতিকতা। এর মূলে ক্ষমতার ছক নেই, আছে এই বিশ্বাস যে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় গোটা দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষের নৈতিক অধিকার আছে। এ কালের পৃথিবীতে আর কোনও দেশ আন্তর্জাতিক সংহতির এই মৌলিক আদর্শে স্থিত থেকে বিভিন্ন উপলক্ষে এমন নিয়মিত ভাবে তার প্রমাণ দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিউবা বাকি পৃথিবীকে কী দিয়েছে, সেটাই আন্তর্জাতিক পরিসরে তার অস্বাভাবিক প্রভাবের পিছনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। জাগতিক ভূমিকার চেয়েও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল নৈতিক প্রভাব।

দৃশ্য ২: লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পশ্চিমী উপনিবেশ এবং মার্কিন মদতে কায়েম হওয়া স্বৈরাচারী জমানার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বড় ভূমিকা নিয়েছে কিউবা। আফ্রিকার দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। স্যঁ জেকবস-এর ভাষায়, ‘আফ্রিকা যদি একটা দেশ হয়, তবে ফিদেল কাস্ত্রো আমাদের এক জন জাতীয় নায়ক।’ পশ্চিমী দেশগুলির (বা অধুনা চিনের) মতো মূল্যবান খনিজ সম্পদ দখলের জন্য কিউবা এই দেশগুলিতে হস্তক্ষেপ করেনি, ঔপনিবেশিক তথা স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। রবেন আইল্যান্ড-এর কারাগার থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছিলেন, ‘এই প্রথম অন্য এক মহাদেশ থেকে একটি রাষ্ট্র এসেছে আফ্রিকা থেকে কিছু নিয়ে যেতে নয়, আফ্রিকানদের স্বাধীনতা অর্জনে সহায় হতে।’ কঙ্গো, গিনি বিসাউ ও কেপ ভের্দে, অ্যাঙ্গোলা বা মোজাম্বিকের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার ভূমিকা সুপরিচিত। ১৯৭৬ ও ১৯৮৮ সালে সদ্য-স্বাধীন অ্যাঙ্গোলায় কেবল বিদ্রোহী জঙ্গি নয়, সিআইএ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী শাসকদের অর্থ ও অস্ত্রে পুষ্ট শ্বেতাঙ্গ ভাড়াটে সৈন্যদের আক্রমণ থেকে নবীন রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে সে দেশের নায়কদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ফিদেল সেনা পাঠিয়েছিলেন। হাজার হাজার কিউবান সৈনিক সেই সংঘর্ষে প্রাণ হারান। অ্যাঙ্গোলায় বিদ্রোহীরা হার মানে। ১৯৮৮ সালে শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকার সেনাও পরাজিত হয়। এর ফলেই সে দেশের বর্ণবিদ্বেষী জমানার অবসান ত্বরান্বিত হয়। অন্য দিকে জন্ম নেয় স্বাধীন নামিবিয়া।

১৯৯১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় পালাবদলের পরে নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে কিউবায় যান এবং ফিদেলকে বলেন, ‘অনেক দেশের মানুষ সম্প্রতি আমাদের দেশে গেছেন। কিউবা আমাদের বন্ধু, সে আমাদের দেশের মানুষকে, বিশেষত চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, নানা ভাবে আমাদের সংগ্রাম জারি রাখতে সাহায্য করেছে। অথচ আপনি আমাদের দেশে যাননি। কবে আসবেন?’ মনে রাখতে হবে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড সহ তথাকথিত মুক্ত দুনিয়ার বহু দেশই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারকে প্রায় শেষ পর্ব অবধি সমর্থন করেছে। সেই দেশে এবং আফ্রিকার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে মহালুণ্ঠনে লিপ্ত ছিল তাদের অনেকেই। পশ্চিম দুনিয়া এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যম ফিদেল ও তাঁর কিউবার যে সমালোচনা করে এসেছে, সে বিষয়ে ম্যান্ডেলা মন্তব্য করেছিলেন, ‘গত চল্লিশ বছর ধরে যারা বর্ণবৈষম্যবাদী শাসনকে সমর্থন করে এসেছে, এখন তারাই আমাদের কিউবা নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে কঠিন সময়ে যারা আমাদের কোনও সাহায্য করেনি, আত্মমর্যাদা থাকলে কারও পক্ষে কখনও তাদের উপদেশ শোনা সম্ভব নয়।’

রোমান্টিক রাজনীতি

ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন এক ভঙ্গুর মানুষ। তিনি ভুল করতেন, নিঃসংকোচে সেই ভুল স্বীকারও করতেন। কিন্তু আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অনেকে যেমন ভালবাসা ও যৌনতা নিয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকেন, তেমন কোনও শুচিবাই তাঁর ছিল না। তাঁর এই মানবিক স্বভাবের কথা জানত বলেই সিআইএ এক বার ফিদেলের প্রাক্তন প্রেমিকা মারিতা লরেন্সকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিল পানীয়তে বিষ মিশিয়ে তাঁকে খুন করতে। ফিদেল সেই ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছিলেন। বাকিটা মারিতার মুখে শোনা যাক। ‘‘আমি ধরেই নিয়েছিলাম ও আমাকে গুলি করবে। কিন্তু আমার হাতে বন্দুকটা তুলে দিয়ে ও বলল, ‘তুমি আমাকে মারতে এসেছ?’ তার পর সিগারে একটা টান দিয়ে ও চোখ বন্ধ করল। ও নিজেকে এতটা দুর্বল করে তুলল, কারণ ও জানত, আমি কাজটা পারব না। ও আমাকে তখনও ভালবাসে, আমিও ওকে।’’ বুলেটটা বের করে নিয়ে লরেন্স ফিদেলের বুকে আশ্রয় নিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর জীবনে বিপ্লবী রাজনীতি আর ভালবাসা হাতে হাত মিলিয়ে চলত।

"আমার বয়েস নব্বইয়ের কাছাকাছি হল। সকলের মতোই আমিও অচিরে বিদায় নেব। কিন্তু আমরা যদি সমবেদনা ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে কাজ করি, তা হলে মানুষের প্রয়োজনীয় বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক সম্পদ সৃষ্টি করতে পারব। কিউবার কমিউনিস্টদের ধারণাগুলি সেটাই প্রমাণ করে।"

-কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির ২০১৬ সালের কংগ্রেসে ফিদেল কাস্ত্রো

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE