অসহায়: বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিলি হওয়া ত্রাণ সংগ্রহের জন্য আকুলতা। ছবি: রয়টার্স
মাসখানেক আগে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালেভেশন আর্মি (আরসা) নামক জঙ্গি গোষ্ঠী ত্রিশটির মতো পুলিশ ছাউনি ও একটি সেনা শিবিরে হানা দিয়ে জনা বারো মানুষকে হত্যা করে। এই অনভিপ্রেত ঘটনার জবাবে ২৫ অগস্ট থেকে মায়ানমারের আইনরক্ষক এবং সেখানকার কট্টরপন্থী বৌদ্ধ নেতৃবৃন্দ অন্তত শ’চারেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। সরকারি বয়ানে এই রোহিঙ্গারা জঙ্গি। অন্য দিকে, রোহিঙ্গাদের তরফে অভিযোগ, সরকারি বাহিনী ও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসম্প্রদায়ের আক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, হয়েছে অবিরাম অত্যাচার। এর ফলে প্রাণভয়ে, বাস্তুচ্যুত পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি রোহিঙ্গা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী। বাংলাদেশে এর আগে থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আছেন— বিগত চার দশকে সে দেশের শরণার্থী শিবিরে বা তার বাইরে লাখ-চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন।
মায়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণের ঘটনা তো এই প্রথম নয়। ১৯৬২ সালে দেশে সেনাশাসনের সূচনা থেকেই কার্যত এর সূত্রপাত। ১৯৮২ সালের নতুন নাগরিকতা আইনের কারণে মায়ানামারে কয়েক শতক যাবৎ বসবাসকারী রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দেশের ১৩৫টি জনজাতি সে দেশের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও রোহিঙ্গাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। বরং, তাঁদের অনেককেই ‘বাঙালি’ অর্থাৎ বহিরাগত বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা শুরু হয়। শুরু হয় ক্রমান্বয়ে মৌলিক অধিকার হরণ। রোহিঙ্গারা বাংলাভাষী না হলেও বিগত এক দশকে মায়ানমারে এই জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে। প্রথম পর্বে রোহিঙ্গাদের তরফে কোনও জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব না থাকলেও আক্রমণের বিরতি ঘটেনি। গত এক মাসে এই আক্রমণ চরম সীমায় পৌঁছনোর ফলে এই রাষ্ট্রবিহীন, কোনও দেশের নাগরিকতাবিহীন রোহিঙ্গারা তাঁদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য দুনিয়ার সাহায্যপ্রার্থী।
অথচ, এই রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই ধর্মীয় বিশ্বাসে মুসলমান হওয়ায় প্রতিবেশী বহু দেশেই এঁদের ঠাঁই হচ্ছে না। ইদানীং ‘ইসলাম-আতঙ্কে’ সন্ত্রস্ত পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রাণের দায়ে আগত শরণার্থীদের মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ না দেখে, প্রধানত নিরাপত্তার আঙ্গিকে দেখার চল হয়েছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম হয়ে উঠতে পারল না। ভারতে চল্লিশ হাজারের কিছু বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা গত চার-পাঁচ বছরে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ‘জাতীয় নিরাপত্তা’-র স্বার্থে তাঁদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে উদ্যত। এমনকী, এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে যাঁরা রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, তাঁদেরও নাকি ঠাঁই দেওয়া যাবে না এই দেশে। ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার হলফনামায় এমন মতই সম্প্রতি প্রকাশিত দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে। বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টেও নাকি এই রোহিঙ্গারা ‘বিপজ্জনক’ বলেই চিহ্নিত। এই চল্লিশ হাজারের মধ্যে সম্ভবত চল্লিশ জনের বিরুদ্ধেও এখনও অবধি সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে জড়িত থাকার নজির নেই। এঁদের বেশির ভাগই কাগজ-কুড়ুনি, লোকের বাড়ি কাজ বা অন্য কোনও সামান্য রোজগারে দিন গুজরান করেন। তা ছা়ড়া, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ‘শরণার্থী’-র বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা সম্ভব। কিন্তু সমস্ত শরণার্থীকে (যাঁদের মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ ও মহিলাদের অনুপাত বেশি) সম্ভাব্য ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া যায় কি? না কি, তা করা বিধেয়? বিদেশি কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের পাশের দাঁড়াবার কথা বললে তার দায় কি রোহিঙ্গাদেরই?
শরণার্থী কাকে বলে? প্রথমত, যখন কেউ নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয়ের জন্য যান, তখনই তাঁকে শরণার্থী বলা হয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর স্বদেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতি বা অন্য কোনও পরিচয়ের কারণে প্রাণসংশয় হতে পারে, এমন আশঙ্কার ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ, এই দেশত্যাগ স্বেচ্ছায় জীবিকার সন্ধানে নয়, একেবারেই প্রাণের দায়ে হতে হবে। আসলে, কাউকে ‘শরণার্থী’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া না হলেও তিনি শরণার্থী। তিনি আশ্রয়প্রার্থী বলেই তাঁকে শরণার্থীর তকমা দেওয়া হয়। অর্থাৎ, তকমার প্রসঙ্গ তুলনায় গৌণ। এবং, কেউ একটি দেশের সীমান্তে আশ্রয়ের জন্য এসে দাঁড়ালে তাঁকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া চলে না। ভিন্দেশে এই আশ্রয়প্রাপ্তি কোনও দয়াদাক্ষিণ্যের প্রশ্ন নয়, একেবারেই অধিকারের প্রশ্ন। শরণার্থীর স্বদেশের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তাঁদেরই স্বেচ্ছাধীন।
আসলে, যে দেশ থেকে প্রাণের দায়ে কিছু মানুষ ভিন্দেশে পালিয়েছেন, সে দেশে জোর করে ফেরত পাঠালে তাঁদের জীবনহানির আশঙ্কা থাকে। জেনে-বুঝে এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অমানবিক ও অনভিপ্রেত। ভারত ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের শরণার্থী সংক্রান্ত প্রোটোকলে সই না করলেও স্বাধীনতার পর থেকে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এসেছে। উল্লেখ্য, দেশভাগের সময় রাষ্ট্রপুঞ্জ তৈরি হলেও শরণার্থী কনভেনশন ছিল না। অথচ, সীমান্তের ও-পার থেকে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু এ দেশে তখন আশ্রয় পেয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয় পাওয়া বেনজির। এর পরেও তিব্বত থেকে, শ্রীলঙ্কা থেকে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আগত শরণার্থীসহ কয়েক লক্ষ ভিটে হারানো মানুষের ঠাঁই হয়েছে এখানে। কিছু মানুষ স্বদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্বেচ্ছায় ফিরে গিয়েছেন। বাকি বেশির ভাগ
এ দেশেই থেকে গিয়েছেন। অর্থনীতির ওপর যথেষ্ট চাপ বাড়লেও দেশের বিপদ বাড়েনি।
অতীতে ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বনাম স্টেট অব অরুণাচল প্রদেশ’ মামলায় (১৯৯৬) স্পষ্ট উল্লেখ করেছিল যে ভারতে পৃথক শরণার্থী আইন না থাকলেও সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ২১ নম্বর ধারায় উল্লিখিত বেঁচে থাকার অধিকার বলে, শুধু ভারতীয় নাগরিক নয়, বিদেশিদেরও বেঁচে থাকার ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার আছে। অর্থাৎ, প্রথমত ১৯৫১ ও ১৯৬৭ সালের শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নিয়মাবলিতে ভারতের প্রত্যক্ষ সায় না থাকলেও নয়াদিল্লি অতীতে অমানবিক হয়নি; দ্বিতীয়ত, ভারত ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র ও পরবর্তী পর্যায়ে এক দিকে মৌল ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অন্য দিকে আর্থ-সামাজিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক নিয়মাবলিতে সম্মতি দিয়েছে। সেই সুবাদে শরণার্থীদের অধিকাররক্ষার প্রসঙ্গও কার্যত স্বীকৃতি পেয়েছে। তৃতীয়ত, শরণার্থী সংক্রান্ত আইনের বাইরেও আশ্রয়প্রার্থী উদ্বাস্তুদের যে জোর করে দেশ থেকে বার করে দেওয়া যায় না, সেই প্রচলিত রীতি ধীরে ধীরে এক সুদৃঢ় আদর্শের রূপ পেয়েছে। এবং চতুর্থত, ভারতীয় সংবিধানেই বিদেশিদের বেঁচে থাকার অধিকার স্বীকৃত। তাই, ভারতের ভূখণ্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ১৯৬৭ সালের ‘পাসপোর্ট অ্যাক্ট’ বা ১৯৪৬ সালের ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’ প্রয়োগ করা বিধেয় নয়। এই আইনগুলির ঊর্ধ্বে কিন্তু দেশের সংবিধান।
যখন মায়ানমারের সমগ্র রোহিঙ্গা জনসম্প্রদায় নতুন ভাবে আক্রান্ত, তখন বিগত বছরগুলিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উৎখাত করার ভাবনা ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বই আর কিছু নয়। তা ছাড়া, দেশের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতকে এঁদের বহিষ্কার প্রসঙ্গে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ না করতে অনুরোধ করাও গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতির পরিপন্থী। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে বা মায়ানমারকে ঘিরে চিন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধের যূপকাষ্ঠে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের বলি দেওয়া অথবা এই উদ্বাস্তুদের কূটনৈতিক দাবাখেলার বো়ড়ে বানাতে উদ্যত হলে তার ফল আখেরে কি ভাল হবে? শরণার্থীর কিছু জাত-ধর্ম কিছু থাকে? আশ্রয় পেলেই তাঁরা কৃতার্থ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy