Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই, তাই জিএসটি চালু হলে লাভ

জিএসটি চালু করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হল। কেন্দ্রীয় সরকার পণ্যের ওপর কর আদায় করবে, আর রাজ্য সরকারগুলো পরিষেবার ওপর— সংশোধনীর মাধ্যমে এই নতুন ব্যবস্থা হল।

প্রস্তুতি: শ্রীনগরে জিএসটি পরিষদের চতুর্দশ বৈঠকের শেষ দিনে সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ১৯ মে, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

প্রস্তুতি: শ্রীনগরে জিএসটি পরিষদের চতুর্দশ বৈঠকের শেষ দিনে সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ১৯ মে, ২০১৭। ছবি: পিটিআই

পিনাকী চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৭ ১৩:১৫
Share: Save:

পয়লা জুলাই থেকেই গোটা দেশে পণ্য ও পরিষেবা কর (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি) চালু হওয়ার কথা। মাত্র সাত বছর তিন মাস দেরি হল! কেন্দ্রীয় সরকার, ২৯টা রাজ্যের সরকার এবং সাতটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল— সব নিয়ে গঠিত ভারতের মতো একটা যু্ক্তরাষ্ট্রীয় দেশে সর্বসম্মতিক্রমে করব্যবস্থার সংস্কার ঠিক কতখানি কঠিন, সেটা এই দেরি থেকে বোঝা যায়।

জিএসটি চালু করার জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হল। কেন্দ্রীয় সরকার পণ্যের ওপর কর আদায় করবে, আর রাজ্য সরকারগুলো পরিষেবার ওপর— সংশোধনীর মাধ্যমে এই নতুন ব্যবস্থা হল। সংস্কারের পর পণ্য ও পরিষেবাকে দুটি আলাদা ক্ষেত্র হিসেবে না দেখে একটি সম্মিলিত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য, দুই সরকারই সে ক্ষেত্র থেকে কর আদায় করতে পারবে।

গত নভেম্বরে গঠিত হওয়ার পর থেকে মোট ১৪ বার জিএসটি পরিষদের বৈঠক হয়েছে। গড়ে প্রতি পনেরো দিনে এক বার যে বৈঠক বসল, তাতে অনেকগুলো জরুরি প্রশ্ন আলোচিত হয়েছে। জিএসটি-র চেহারা ঠিক কী রকম হবে, করের হার কী হবে, জিএসটি-তে যদি কোনও রাজ্যের রাজস্ব ক্ষতি হয়, তবে তা কী ভাবে পুষিয়ে দেওয়া হবে, সব বিষয়ই পরিষদের বৈঠকে নির্ধারিত হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এটা মস্ত কৃতিত্ব। সত্যিই যে রাজ্যগুলি নিজেদের স্বার্থের কথা না ভেবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এ ভাবে এগিয়ে এসেছে, পরস্পরকে বিশ্বাস করেছে, তাতে বোঝা যায়, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এত দিনে পরিণত হয়েছে। জিএসটি চালু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারেরও যেমন আলাদা ভাবে কর আদায়ের সুযোগ থাকবে না, রাজ্য সরকারগুলিরও থাকবে না। পরোক্ষ কর বলতে জিএসটি-ই প্রধান হবে। আশা করা যায়, এক এক রাজ্যে এক এক রকম করের হারের সমস্যা আর থাকবে না, গোটা দেশে একটা অভিন্ন বাজার তৈরি হবে, করের ওপর কর চাপানোর প্রবণতা বন্ধ হবে, আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য, লগ্নি ও ব্যবসা বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় আয় বাড়বে।

কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি এত দিন যত পরোক্ষ কর আদায় করত, জিএসটি চালু হলে প্রায় সবগুলিই তার আওতায় চলে আসবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যে করগুলি জিএসটি-তে মিশে যাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: কেন্দ্রীয় উৎপাদন শুল্ক; উৎপাদনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক; অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক; পরিষেবা করের ওপর বিশেষ অতিরিক্ত শুল্ক এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সেস ও সারচার্জ ইত্যাদি। রাজ্য সরকারের হাত থেকে চলে যাচ্ছে স্টেট ভ্যাট, কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, বিলাসপণ্যের ওপর কর, প্রবেশ কর, বিনোদন কর, বিজ্ঞাপনের ওপর কর, খরিদ কর, লটারির ওপর কর, বিভিন্ন রাজ্য সেস ও সারচার্জ ইত্যাদি। পেট্রোলিয়াম পণ্য, মদ, রিয়াল এস্টেট এবং বিদ্যুতের ওপর করকে জিএসটির আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, পরোক্ষ করের একটা বড় অংশ জিএসটি-র আওতায় চলে এসেছে ঠিকই, কিন্তু বাইরেও থেকে গিয়েছে অনেক কিছু। কিছু পণ্য এবং পরিষেবাকে জিএসটি-র বাইরে রাখা এই প্রক্রিয়ার অসম্পূর্ণতা। সংস্কার সম্পূর্ণ হল না। জিএসটি থেকে দেশের অর্থনীতির যতখানি লাভ হওয়া সম্ভব, তার পুরোটা আদায় করে নিতে হলে এই অসম্পূর্ণতা রাখলে চলবে না। তবে, এখনই যতটা এগোনো গিয়েছে, তা বর্তমান পরোক্ষ কর ব্যবস্থার তুলনায় অনেক ভাল।

এখন আন্তঃরাজ্য বিক্রয় করের যে ব্যবস্থা চালু, তার গোড়ায় গলদ। কোনও পণ্য যেখানে উৎপাদিত হয়, এখনকার ব্যবস্থায় তার ওপর বিক্রয় কর আদায় করে সেই রাজ্যই। অর্থাৎ, কেউ যদি কলকাতায় একটা মারুতি গাড়ি কেনেন, সেই গাড়ির ওপর দেওয়া পরোক্ষ করের একটা অংশ হরিয়ানার সরকারের রাজকোষে যায়। দেশের সব রাজ্যে সমান পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হয় না। যে রাজ্যে উৎপাদন বেশি, সেই রাজ্যগুলোও তুলনায় ধনী। আন্তঃরাজ্য বিক্রয় করের এখনকার নিয়মে সেই ধনী উৎপাদক রাজ্যগুলির রাজকোষে গরিব ক্রেতা রাজ্যের থেকে অনেক টাকা ঢোকে। তার ফলে অনপনেয় আর্থিক অসাম্য তৈরি হয়। উৎপাদন বেশি, এমন বেশ কয়েকটি রাজ্য যে গোড়ায় জিএসটি নিয়ে আপত্তি করেছিল, এবং এখনও জিএসটি-র নিয়ম নিয়ে খুব খুশি নয়, সেটা এই কারণেই। জিএসটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি এই প্রেক্ষিতে আশ্চর্যজনক। এই রাজ্যে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ বেশি নয়। এই রাজ্যে উৎপাদনের তুলনায় ভোগ বেশি হয়, অর্থাৎ রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ নেট ক্রেতা। ফলে, কোনও পণ্য যেখানে ভোগ করা হচ্ছে, জিএসটি-তে যেহেতু সেই রাজ্যই কর আদায় করবে, ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্বের পরিমাণ বাড়বে। তার ওপর বিভিন্ন পরিষেবার উপরও কর পাওয়া যাবে। ফলে, আন্তঃরাজ্য বিক্রয় কর বাবদ যেটুকু ক্ষতি হবে সেটা বাদ দিয়ে, এবং ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট অ্যাডজাস্টমেন্টের পরও পশ্চিমবঙ্গের লাভ।

প্রশ্ন হল, জিএসটি চালু হলে কি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ক্ষতি হবে? রাজ্যের হাতে কর আদায়ের ক্ষমতা থাকার অর্থ, কোন পণ্য বা পরিষেবার ওপর করের হার ধার্য করার ও সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার অধিকার রাজ্যের হাতে থাকা। জিএসটি চালু হলে কোনও রাজ্যেরই আর এই ক্ষমতা থাকবে না। পরোক্ষ করের হারে সমতা বজায় রাখার স্বার্থে রাজ্যগুলির স্বাধিকার বলি দেওয়া হল। কিন্তু, কথাটা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। কেন্দ্রও আর জিএসটি পরিষদের সম্মতি ছাড়া কোনও পণ্য বা পরিষেবার ওপর করের হার বদলাতে পারবে না।

কিন্তু, এখানেই আটকে না থেকে বড় ছবিটার দিকে তাকানো প্রয়োজন। এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায় সরকারের রাজস্ব নীতি— বিশেষত কর নীতি— অনেক দিন আগেই তার মাহাত্ম্য হারিয়েছে। যেমন ধরুন, দুনিয়ার সব সরকারই এখন আন্তর্জাতিক পুঁজিকে নিজের দেশে টানতে চায়। ফলে, সেই বাজারে প্রতিযোগিতা মারাত্মক। অতএব, ভারত চাইলেও অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক চড়া হারে কর্পোরেট কর আদায় করতে পারবে না, তাকে আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি হারই বজায় রাখতে হবে। দেশের রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও পরোক্ষ করের সমতাবিধানের মাধ্যমে সেই কাজটাই করা হল। তবে, আরও বড় প্রশ্ন হল, বিভিন্ন রাজ্যে করের হার সমান হলেই কি সব রাজ্যের পক্ষে বিনিয়োগ টানা সমান সহজ হবে? সম্ভবত না। শুধু হারের সমতা নয়, তার জন্য প্রয়োজন প্রক্রিয়ার সমতা। প্রতিটি রাজ্য নিজের মতো করে রাজ্য স্তরের জিএসটি আইন তৈরি করছে। যদি কর আইনের ক্ষেত্রে এক এক রাজ্যে এক এক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, তবে হারের সমতা দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যাবে না।

এখন যে রাজ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ক্ষতির কথা বলে হরেক আপত্তি তুলছে, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন— যখন সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছিল, তখন ছিলেন কোথায়? জিএসটি-র চরিত্রই এমন যে তার মোড় ঘোরানো সম্ভব নয়। এই নতুন ব্যবস্থায় যতখানি সুবিধা আদায় করা সম্ভব, এখন বরং সে দিকে মন দিন।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি, নয়াদিল্লি’তে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Arun Jaitley GST West Bengal industry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE