—ফাইল চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতি শান্ত স্বরে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন— কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট রাজ্যগুলিকে ভরসা করা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। কেন্দ্র এই মর্মে নির্দেশ পাঠাইয়াছিল যে, কন্টেনমেন্ট জ়োনের বাহিরে কোথাও লকডাউন করিতে হইলে তাহার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি লইতে হইবে। সেই প্রসঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথাটি বলিলেন। অবশ্য, শুধু লকডাউনের ক্ষেত্রেই নহে, কথাটি সর্ব ক্ষেত্রেই সত্য। কেন্দ্রীয় সরকার পথনির্দেশ দিতে পারে, পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু রাজ্যের কোথায় কী ভাবে কোভিড-১৯’এর সহিত লড়িতে হইবে, তাহা স্থির করিবার অধিকার রাজ্য সরকারের হাতে থাকাই বিধেয়। বস্তুত, এই সিদ্ধান্তগুলি এমনই ক্ষেত্রসাপেক্ষ যে, রাজ্য সরকারেরও উচিত স্থানীয় প্রশাসনের বিবেচনার উপর নির্ভর করা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বহুলাংশে সেই পথেই হাঁটিয়াছে। কোথাও লকডাউন প্রয়োজন কি না, সেই সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে অধিকতম গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে জেলাশাসক বা পুরসভার মতামতকে। সিদ্ধান্তের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিলে নিয়ন্ত্রণ হারাইবার খানিক ভয় থাকে বটে, কিন্তু অতিমারির মতো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়িবার সময় তথ্যের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্থানীয় স্তরকে যথাযথ ব্যবহার না করিলে বিপদের সম্ভাবনা আরও বাড়ে। খেলাটি আসলে ভারসাম্য রক্ষার। কী ভাবে স্থানীয় স্তরের তথ্য, মতামতকে ব্যবহার করিয়া রণনীতি প্রস্তুত করিতে হইবে, তাহা জানা বা না-জানিবার উপর যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে।
কেন্দ্রীয় সরকার গোড়া হইতেই এই কথাটি বুঝিতে অস্বীকার করিয়াছে। একতরফা লকডাউন ঘোষণাই হউক, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন পাঠাইবার সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রেই হউক বা বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সহিত বৈঠকে অনেককে কথা বলিবার সুযোগমাত্র না দেওয়ার ক্ষেত্রে— কোভিড-এর বিরুদ্ধে লড়াইটি যে যূথবদ্ধ ভাবে লড়িতে হইবে, কেন্দ্রীয় সরকার মানিতে চাহে নাই। নিয়ন্ত্রণের অদম্য বাসনাই হউক, বা সব কৃতিত্বের একচ্ছত্র মালিকানার আকর্ষণ, কেন কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রাশ নিজের হাতে রাখিতে চাহিয়াছে, সেই বিষয়ে তর্ক চলিতে পারে— কেহ বলিতে পারেন, ইহা একনায়কতন্ত্রের চরিত্রলক্ষণ— কিন্তু, কোভিড-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাহা যে আদর্শ পন্থা নহে, সে বিষয়ে তর্ক নাই। বিশেষত ভারতের ন্যায় বিপুল দেশে রাজ্য সরকারগুলির অনেক বেশি স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকা বিধেয়। রাজ্যগুলি তাহাদের প্রয়োজন অনুসারে কেন্দ্রের সাহায্য চাহিবে এবং কেন্দ্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে— এই চাহিদা-নির্ভর ব্যবস্থাই কাম্য।
এক্ষণে আরও একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিগত কয়েক দিনে, মূলত অর্থনীতির প্রশ্নে, বারংবার রাজ্যগুলির লকডাউনের প্রসঙ্গে আসিয়াছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বাৎসরিক রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াও বলা হইয়াছে, রাজ্যগুলিতে বিক্ষিপ্ত লকডাউন চলায় আর্থিক পুনরুত্থানের প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। এই কথার মধ্যেই রাজ্যগুলিকে লকডাউনের অনুমতি লইবার কথা বলায় কেহ একটি নকশার উপস্থিতি লক্ষ করিতে পারেন— কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ব্যর্থতার দায় রাজ্যগুলির উপর চাপাইবার ক্ষেত্র প্রস্তত করা হইতেছে। কেন্দ্র যদি সত্যই সেই পথে হাঁটে, তাহা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমত, বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম তিনটি মাস ভারতীয় অর্থব্যবস্থার প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় রাজ্য বিক্ষিপ্ত লকডাউনের পথে হাঁটিলেও তাহা ঘটিয়াছে জুলাই মাস হইতে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যগুলি যখন অতিমারির বিরুদ্ধে যথাসাধ্য লড়িতেছে, তখন কেন্দ্র নিজেদের আর্থিক ব্যর্থতার দায় যদি তাহাদের উপর চাপাইতে চাহে, তবে তাহা ভারতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতেও অতি হীন কাজ হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy