অধুনা বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধুম। এক দিকে বাঙালি ও বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতার নিনাদ, অন্য দিকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির বিপন্নতার ত্রস্ত বিজ্ঞাপন। বাঙালি উদ্বেল। অমন ভেসে যাওয়া, ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষণে দু’-একটা কথা তবু সুচের মতো বেঁধে। যেহেতু রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাতেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন, এবং সেই ভাষাতেই আমাদের পদে পদে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সংকীর্ণ জাতিপ্রেমের বিপদের কথা, একবার উল্টে পাল্টে পরখ করা যায় আত্মমুগ্ধ বাঙালি অপরদের কোন চোখে দেখে, বিশেষত সেই অপর, যার নিবাস এই পশ্চিম বঙ্গভূমে।
সরকার প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকগুলোতে চোখ মেলালেই কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে। পঞ্চম শ্রেণি থেকেই বিশ্ব যোগাযোগ গড়ে তোলার অসামান্য উদ্যম, এডওয়ার্ড লিয়র-এর লিমেরিকের তরজমা দিয়ে যার শুরু। ক্রমে ক্রমে যত উঁচু ক্লাসে ওঠা যাচ্ছে ততই বিশ্ব পরিসরে বেড়ে ওঠা: ল্যাংসটন হিউজ, পাবলো নেরুদা, লিয়ো টলস্টয়, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, বের্টোল্ট ব্রেখ্ট। ভারতীয়রাও আছেন, যেমন, পান্নালাল পটেল, কেদারনাথ সিংহ। কিন্তু, সেই যে কবির কথা, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’। এতগুলো পাঠ্যবইতে বৃহৎ বিশ্বকে স্থান দিতে গিয়ে এ বঙ্গেরই নিবাসী নেপালি বা সাঁওতালি ভাষার সাহিত্য স্রষ্টার কোনও অনুবাদের জন্য একটুও জায়গা জুটল না, কী কাণ্ড।
আদিকবি ভানুভক্ত, যিনি রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন, তাঁর জন্মদিন পালিত হয় ঘটা করে, কিন্তু তাঁর বা অন্যান্য নেপালিভাষী সাহিত্যিকের লেখা পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। তেমনই, প্রায় ধর্মীয় আচারের মতো প্রতি বছর পালিত হয় হুল উৎসব— সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতিতে, কিন্তু সারদাপ্রসাদ কিসকু বা অন্যান্য সাঁওতাল লেখক-লেখিকাদের রচনাও যে পাঠ করা দরকার, সেই বোধটাই যেন অহমিকায় আচ্ছাদিত।
কিন্তু এ-সব প্রশ্ন করতে মানা। সঙ্গে সঙ্গে আপনার গায়ে লেবেল সেঁটে দেওয়া হবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থক’। অতি বড় গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীলও বুক বাজিয়ে বলে যাচ্ছেন, ‘প্রাণ থাকতে গোর্খাল্যান্ড হতে দেব না’। সেই ১৯৮০’র দশকেই, গোর্খা জনগোষ্ঠীর লোকেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি ওঠার কালেই, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়টিকে যুদ্ধের ভাষায় বর্ণিত করল: ‘রক্ত দেব, গোর্খাল্যান্ড দেব না’। এখনও তাই, প্রাণ দেওয়ার বাসনায় যার ‘উত্তরণ’। সেই সঙ্গে ‘ওদের’, অর্থাৎ গোর্খা জনগোষ্ঠীর লোকেদের ‘টাইট’ দেওয়ার ধর্ষকাম আনন্দ: ‘আমরা’ পাহাড়ে না গেলে ‘ওদের রুজি রুটি বন্ধ।’ কেন তাঁরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চান, বাংলার শাসনকে তাঁরা কোন চোখে দেখেন, এ সব নিয়ে অনুসন্ধান নয়, আলোচনা নয়, কেবল দমনের মধ্য দিয়ে শাসন চালিয়ে যাওয়া।
পাহাড় থেকে আসা মানুষমাত্র জানেন একই রাজ্যের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও সমতলে তাঁরা পরবাসী। এমনিতেই, আমাদের চোখে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সব মানুষরাই নেপালি, তাঁদের জাতি গোষ্ঠীগত, ভাষা-সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জানবার ইচ্ছাই নেই, চেষ্টা তো দূর।
একই কথা আদিবাসী বিষয়েও, মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয় আদিবাসী মানে সাঁওতাল, অথচ ২০১১-র জনগণনায় দেখতে পাচ্ছি, সাঁওতালিরা পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসীদের ৪৮ শতাংশ। আবার প্রায়শই সাঁওতালি ভাষার হরফ অলচিকি-কে ভাষা বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লিপি ও ভাষা যে আলাদা সেটা আমরা জানি, কিন্তু সাঁওতালিদের আবার অত কিছু আছে জেনে আমরা বক্রবিস্ময়ে হাসি। অথচ আমরা জানি না, এঁদের কথা না জেনে আমরা নিজেদেরই কতটা অজ্ঞানতার তিমিরে ফেলে রাখি। সাঁওতালি ভাষা যে কত সমৃদ্ধ তার প্রমাণ পাওয়া যায় পি ও বোডিং সংকলিত পাঁচ খণ্ডের সাঁওতালি অভিধানে। অন্য এক আদিবাসী গোষ্ঠী, মুন্ডাদের ভাষা মুন্ডারি ভাষার এনসাইক্লোপিডিয়া আছে ১৪ খণ্ডে। তেমনই ওরাওঁদের সমৃদ্ধ ভাষা কুরুখ। কোড়াদেরও আছে নিজস্ব ভাষা (বীরভূমে ‘সূচনা’ সংস্থা এই ভাষায় পাঠ্যবই রচনা করে শিশুদের পড়াচ্ছে)। রাভা, টোটো, লেপচা, ভুটিয়া, কত ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন এই বাংলারই লোক! আমরা আর্মেনীয় রূপকথাও তরজমায় পড়তে পারি, এবং অবশ্যই সেটা গৌরবের ব্যপার। কিন্তু যে বাংলা ভাষার এত বিপুল ধারণক্ষমতা, সেই ভাষায় সাঁওতালি মুন্ডারি নেপালি এবং অন্যান্য ভাষার সাহিত্যগুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগের এত অভাব কেন?
সুখের কথা, এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে বোডিং সংকলিত সাঁওতাল লোককথাগুলোর তিন খণ্ডে তরজমা হচ্ছে। কেউ কেউ অন্য রকম ভাবছেন, সেটা খুব বড় কথা। কিন্তু আমাদের শাসকরা, তাঁদের লালিত-পালিত বঙ্গ-সংস্কৃতির উন্নাসিক মুরুব্বিদের চিন্তা-চেতনায় আঁচড় নয়, বজ্রাঘাত চাই। সেটা যত দিন না হবে, তত দিন বাংলার ‘অপর’রা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে, আরও দূরে সরে যাবে। বিশ্ব-যোগাযোগ ঘটানোর একটা অর্থ যে নিজের সঙ্গেও যোগাযোগ, সে কথাটা বোঝা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy