Advertisement
E-Paper

গোপীনাথ মন্দিরে গোপন বৈঠক বিপ্লবীদের

জাঁকজমকে পূর্ণ ছিল মন্দিরটি। বিগ্রহের সেবায় রানি দান করেছিলেন বহু সম্পত্তি। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই মন্দিরই নেতাদের নিরাপদ আশ্রয়। স্বাধীনতা পক্ষ আজ মন্দিরময়। লিখলেন হরিপদ মাইতিজাঁকজমকে পূর্ণ ছিল মন্দিরটি। বিগ্রহের সেবায় রানি দান করেছিলেন বহু সম্পত্তি। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই মন্দিরই নেতাদের নিরাপদ আশ্রয়। স্বাধীনতা পক্ষ আজ মন্দিরময়। লিখলেন হরিপদ মাইতি

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৯ ০১:২৬
দেউলপোতার মন্দিরের বর্তমান অবস্থা এমনই। (ডানদিকে) গোপীনাথের বিগ্রহ। ছবি লেখকের সৌজন্যে।

দেউলপোতার মন্দিরের বর্তমান অবস্থা এমনই। (ডানদিকে) গোপীনাথের বিগ্রহ। ছবি লেখকের সৌজন্যে।

লবণ সত্যাগ্রহ তখন জোরদার। দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে থেকে গ্রামে। পুলিশ প্রবল দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রথমসারির নেতারা রণকৌশল ঠিক করতে গোপন বৈঠক করছেন। সেই বৈঠক হচ্ছে এক মন্দিরে। কারণ মন্দিরটি বিপ্লবী নেতাদের কাছে নিরাপদ। মন্দিরটির মহিষাদল রাজপরিবারের নির্মাণ করা গোপীনাথের মন্দির। দেউলপোতার গোপীনাথ মন্দির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগেই কীর্তিমান। কারণ এই মন্দিরটি মহিষাদল রাজের প্রথম স্থাপত্যকীর্তি।

মহিষাদল রাজপরিবারের সবচেয়ে বিচক্ষণ, ধর্মপ্রাণ ও সৃজনশীল রাজ্ঞী হলেন রানি জানকী। স্বভাবতই, রাজাদের সমস্ত দেব-দেউল নির্মাণের কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। বাস্তবে তা ঠিক নয়। বর্তমানের দধিমাধবজির মন্দির এবং সুউচ্চ রাসমঞ্চ তৈরি করেন রানি ইন্দ্রাণী। রাসমঞ্চটি আর নেই। মহিষাদলের বিখ্যাত দারুময় রথ নির্মাণ করেন রাজা মতিলাল উপাধ্যায়। রানি জানকীর ধর্মপ্রাণতা এবং দেব-দেউল নির্মাণের প্রবণতা থেকে সাধারণ মানুষ মনে করেন, রাজপরিবারের মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনিই। এবং তাঁদের সৃষ্ট প্রথম মন্দির দেউলপোতার গোপীনাথের মন্দির। কিন্তু এই তথ্য ঠিক নয়। বলা উচিত, রাজবাড়ির স্থাপত্য নির্মাণ শুরু হয়েছে রানি জানকীর স্বামী রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায়ের হাতে। গোপীনাথের মন্দির তাঁরই তৈরি।

এই মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গে রাজবাড়ির প্রধান ও প্রথম ইতিবৃত্তকার ভগবতীচরণ প্রধান তাঁর ‘মহিষাদল রাজবংশ’ গ্রন্থে লেখেন ‘মন্দির গাত্রে দেখা যায় ধ্বংসীভূত বর্ণাবলীর মধ্যে ‘সন হাজার ১৫০ সাল’ স্পষ্ট লিখিত আছে। তাহা হইলে ইহা অনুমান করিতে হইবে উহা ১১৫০ সাল’। ভগবতীচরণ জানিয়েছেন, ১১৫০ সালে রাজ্ঞী জানকী রাজকাজে যুক্ত হননি। তিনি ১১৭৭ সালে রাজকাজে হাত দিয়েছিলেন বলে অনেক প্রমাণ মেলে। তাই রানিকে কোনও ভাবেই ওই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না। তাঁর স্বামী রাজা আনন্দলাল উপাধ্যায় ১১৪৫ সালে রাজা হন। এবং ১১৫০ সালে তিনিই এই মন্দির নির্মাণ করেন, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা বলা যেতে পারে। ধর্মপ্রাণ রানি রাজকাজে যোগ দিয়ে মন্দিরের দেবতার সেবায় অনেক সম্পদ দান করেছিলেন। এটা সঙ্গত বলে অনুমান করা যায়। সতীশচন্দ্র মাইতির লেখা ‘বালাবোধ’ গ্রন্থেও একই কথা বলা হয়েছে। এ কথা সম্পূর্ণ সঠিক যে রানি জানকী রাজকাজে মগ্ন হয়েই ওই মন্দিরের সেবা ও রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত দায়িত্ব নেন। সে কারণেই লোকেরা মন্দিরটি রানি জানকীর তৈরি বলে মনে করা হয়।

মহিষাদল রাজবাড়ির মন্দির ভাস্কর্য অপরূপ। প্রায় ৫০ ফুট উঁচু সবগুলিই বিশাল মন্দির। গোপীনাথের মন্দির তার ব্যতিক্রম নয়। এটিও ছিল গোপাল জিউ বা রামজি মন্দিরের মতো উঁচু। কিন্তু এর শৈলী ছিল ভিন্ন। এটি নবরত্ন মন্দির নয়। সোজা হয়ে উঠে যাওয়া সর্বোচ্চ ধাপে তিনটি চূড়া। সরু ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত মন্দিরের দেওয়াল প্রায় আড়াই ফুট চওড়া। পুবমুখো এই মন্দিরের গর্ভগৃহটি খুব প্রশস্ত নয়। মন্দিরের উত্তর দিকে ছিল একটি ঘর। তার পরে ছিল বড় একটি নাট্যমঞ্চের মতো দালান। তার বাইরে ছিল প্রবেশদ্বার। সেখানেই ছিল নহবতখানা। মন্দিরে পূজিত হতেন গোপীনাথ বা কৃষ্ণ। বাইরে ছিল হরিমঞ্চ। তুলসী-সহ সেই হরিমঞ্চ পুজো পেত প্রতিদিন। অন্য মন্দিরের মতো গোপীনাথের মন্দিরে নিত্যভোগের ব্যবস্থা হত। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এখানে প্রসাদ পেতেন। রাজপরিবার মন্দিরের জন্য দশ বিঘা জমি দান করে। মন্দিরের সামনে এক বিশাল পুকুর খনন করান। মন্দিরের প্রথম পুরোহিত ছিলেন বসন্তকুমার পণ্ডা। তাঁকে আনা হয়েছিল ওড়িশার জজপুর থেকে।

গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক পঙ্কজলোচন মহাপাত্র বলেন, ‘‘মন্দিরের জন্য দশ বিঘেরও বেশি জমি ছিল। তার আয়ে মন্দিরের কাজকর্ম চলত। প্রতিদিন কাঁসর, শাঁখ, ঘণ্টাধ্বনিতে মন্দির চত্বর ভরে যেত। আজ প্রায় সত্তর বছর হল সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের প্রায় সমস্ত সম্পত্তি হয় বিক্রি নয় বেদখল হয়ে গিয়েছে। সামনের বিশাল পুকুরটিও একজন কিনে নিয়েছেন।’’ পঙ্কজলোচন নির্দিষ্ট পুরোহিতের অবর্তমানে কয়েকদিন মন্দিরে পুজো করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, মন্দিরটি চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। ভিতরে ছিল প্রচুর ফলের গাছ। গ্রীষ্মকালে গ্রামের বাসিন্দারা এসে মন্দিরের দালালে ঘুমোতেন। তবে বিগ্রহটি ঠিক কোথায় আছে তার সঠিক তথ্য নেই। পঙ্কজলোচন বলেন, ‘‘বিগ্রহটি সম্ভবত সম্ভবত গোপাল জিউ মন্দির সংলগ্ন কোনও ঘরে রাখা আছে।’’

গোপীনাথ মন্দিরটি স্থাপত্যের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। রাজরাজড়াদের ইতিহাসেও। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও মন্দিরটির গুরুত্ব রয়েছে। গ্রামের অনেকটা ভিতরে অবস্থিত হওয়ায় মন্দিরটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন আস্তানা। বিশেষ করে লবণ সত্যাগ্রহের সময়। স্বাধীনতা সংগ্রামী কুমারচন্দ্র জানার নেতৃত্বে সুতাহাটা থানায় লবণ সত্যাগ্রহ দুর্বার হয়েছিল। বাবুপুরে সত্যাগ্রহীদের উপর ব্রিটিশ পুলিশ প্রবল অত্যাচার করে। বালুঘাটায় স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ শিবিরে পুলিশ দমন-পীড়ন চালায়, সারা সুতাহাটা উত্তাল হয়ে ওঠে। এই সব ঘটনার সময়ে নেতারা মন্দিরে গোপন বৈঠক করতেন। আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হত। আলোচনা চলত মন্দির সংলগ্ন ঘরটিতে। আসতেন সুশীলকুমার ধাড়া, সতীশচন্দ্র সামন্ত, কুমারচন্দ্র জানা, বিল্বপদ জানা, হরিপদ জানা, ক্ষুদিরাম ডাকুয়া ও কুমুদিনী ডাকুয়ার মতো নেতারা। পুলিশের পক্ষে তাঁদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তাঁরা নিরাপদে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন গোপন বৈঠক সামলাতে পারতেন।

মন্দিরটি এখন ধীরে ধীরে ধসে পড়ছে। ঝোপজঙ্গলে ভরা মন্দিরের কাছ পর্যন্ত যাওয়া যায় না। গ্রামবাসীরা জানান, সাপখোপের আড্ডা হয়েছে মন্দির। তাই আর লোকজন কেউ আসেন না। মন্দিরের গায়ে জন্মেছে বড় বড় গাছ। এমনই একটি প্রত্নসম্পদ অবহেলায় ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা মন্দিরটি সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন। কিন্তু কাজ কিছু হয়নি। মহিষাদল রাজাদের তৈরি রাসমঞ্চ এক রাতে সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। রঙ্গিবসান প্রাসাদ, রামজিউর মন্দির, মহিষাদল রাজ হাইস্কুলের আদি বাড়ি, সব ভগ্নপ্রায়। এগুলি অদূর ভবিষ্যতে ধ্বংসের পথে চলে যাবে।

গোপীনাথ মন্দির সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলে হারিয়ে যাবে স্থাপত্য, রাজকীর্তি আর স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এক নিদর্শনের ইতিহাস।

লেখক মহিষাদল রাজ কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক

Gopinath Temple
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy