Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
জনপ্রিয়তাবাদের ফর্মুলা: নমনীয় মতাদর্শ ও জনমোহিনী স্লোগান

এই এক নতুন রাজনীতি

আন্দোলনকারী গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় পুলিশ চৌকিতে আগুন দিয়ে বাইশ-তেইশ জন পুলিশকর্মীকে পুড়িয়ে মারে (৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২২) তার এক সপ্তাহের মধ্যে (১২ ফেব্রুয়ারি) গাঁধীজি জাতীয় স্তরে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বা‌ংলায় যা ‘গণ-আন্দোলন’ বলে পরিচিত, হিন্দিতে কি তাকেই এখন ‘জন’ আন্দোলন বলে? অনেকটা এক রকম শোনালেও, বা দুইয়ের মধ্যে প্রয়োগ ও প্রকরণে অনেকখানি মিল থাকলেও তারা সমার্থক নয়। বিশেষত বামপন্থার প্রভাবে প্রথম ধরনের আন্দোলনটি কোনও দল বা পার্টি-উৎসারিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং সেই কারণে অনেক শৃঙ্খলিত। প্রচুর মানুষ যোগদান করলেও ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র পরিমাণ সেখানে কম। বাংলায় বামপন্থীরা ‘গণ’-আন্দোলনে হাত পাকালেও, ভারতে সেই অর্থে গণ-আন্দোলনের জনক কিন্তু মহাত্মা গাঁধী। জীবন ও রাজনীতিতে পূর্ণ শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী মহাত্মা চাইতেন ব্রিটিশ-বিরোধী এমন আন্দোলন পরিচালনা করতে, যেখানে আন্দোলনের উত্তুঙ্গ অবস্থাতেও সর্বোচ্চ নেতার আদেশে আন্দোলনকারীরা প্রয়োজনে নিজেদের আবেগ সংহত রেখে আন্দোলন গুটিয়ে নিতে দ্বিধা করবেন না।
সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলনের বাস্তব অবশ্য এতটা পরিকল্পনামাফিক চলে না। ফলে অসহযোগ আন্দোলনে যখন এক দল উত্তেজিত আন্দোলনকারী গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরায় পুলিশ চৌকিতে আগুন দিয়ে বাইশ-তেইশ জন পুলিশকর্মীকে পুড়িয়ে মারে (৫ ফেব্রুয়ারি ১৯২২) তার এক সপ্তাহের মধ্যে (১২ ফেব্রুয়ারি) গাঁধীজি জাতীয় স্তরে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। একই ভাবে, অসহযোগ আন্দোলনের আবহে অযোধ্যার কৃষকরা বাবা রামচন্দ্র নামে এক স্থানীয় সাধুর নেতৃত্বে প্রায় স্বাধীন ভাবে ইংরেজদের অসহযোগের পাশাপাশি নিজেরাই স্থানীয় জমিদার-তালুকদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করার বা তাদের ধোপা-নাপিত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গাঁধী, মোতিলাল ও জওহরলাল নেহরু তখন দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের এমন ‘অসংযত’ আচরণের জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেন। কিন্তু দল বা নেতার আদেশ-নিয়ন্ত্রণ পেরিয়ে এই যে ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’, এটাই ‘জন’-আন্দোলনের, বা ‘জনপ্রিয়’ (পপুলার) আন্দোলনের আপেক্ষিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রটির প্রসার ঘটায়। অনেক ক্ষেত্রে গোড়ায় পার্টি-নিয়ন্ত্রিত হলেও আন্দোলন যত ‘জনপ্রিয়’ হয়, ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’র হার বাড়তে থাকে।
এই দিক থেকে দেখলে, স্বাধীনতার পর থেকে সত্তরের দশকের শুরু অবধি, পশ্চিমবঙ্গে বাম দলগুলি সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে যে সব ‘গণ আন্দোলন’, যেমন, উদ্বাস্তু আন্দোলন, ট্রামভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন ও সর্বোপরি খাদ্য আন্দোলন গড়ে তুলে নিজেদের সমর্থন ভিত্তি বাড়িয়েছিল, তার সব ক’টির মধ্যেই কমবেশি দলীয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল চোখে পড়ার মতোই। তাই এই সব আন্দোলন চরিত্রগত ভাবে একাধারে ‘গণ’ এবং ‘জনপ্রিয়’ বা ‘পপুলার’ আন্দোলনও বটে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজবিজ্ঞান গবেষণা গোষ্ঠী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপের (সিআরজি) গবেষকরা গত কয়েক বছর ধরে জার্মানির সংস্থা, রোজ়া লুক্সেমবার্গ স্টিফটুং-এর (আরএলএস) সহায়তায় এই সময়কালীন বাংলা ও বিহারের নানা
দিঙ্‌নির্ণয়ী ‘জনপ্রিয়’ আন্দোলন নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণা চালিয়েছেন। কিন্তু সত্তরের দশকের মধ্যভাগ থেকে, বিশেষত নব্বইয়ের দশকের পর থেকে, সোভিয়েত দাপট-মুক্ত বিশ্বের নানা দেশে একটা নতুন ধরনের রাজনীতির ঝোঁকও বাড়তে থাকে, যা প্রথাগত দল ও সরকারি প্রতিষ্ঠাননির্ভর (যেমন, আইনসভা বা প্রশাসন) চেনা রাজনীতির চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন।
বস্তুত, চেনা চশমা দিয়ে দেখলে এই নতুন রাজনীতির চলন ও ব্যাকরণ অনুধাবন করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। চালু লব্জে বললে, এই নতুন রাজনীতিকে ‘জনপ্রিয়তাবাদী’ (‘পপুলিস্ট’) বলা চলে। এক সময়ের আর্জেন্টিনার পেরন, ভারতের ইন্দিরা গাঁধী, পাকিস্তানের জ়ুলফিকর আলি ভুট্টো, ভেনেজ়ুয়েলার উগো চাভেস, বলিভিয়ার ইভো মোরালেস, সাম্প্রতিক ভারতে জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী— দেশ-কাল ও রাজনীতির ভিন্নতা সত্ত্বেও, এঁদের সবাইকেই ‘জনপ্রিয়তাবাদী’ বলা চলে। অতি সম্প্রতি কলকাতায় সিআরজি এবং আরএলএস-এর যৌথ উদ্যোগে এই নতুন রাজনীতির হালচালের হদিস পেতে (‘হু আর দ্য পিপল? পপুলিজ়ম অ্যান্ড পপুলিস্ট মুভমেন্টস’ শীর্ষক) একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল। এই নতুন রাজনীতির সঙ্গে জনগোষ্ঠীর (‘এথনিক’ অর্থে) সম্পর্ক, চেনা বাম ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতির ঝোঁক বদল, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি ও নেতৃত্বের উত্থানে প্রথাগত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বিপন্নতা, দিল্লির আম আদমি পার্টির অ-প্রথানুগ রাজনীতি ও সরকারি নীতি, যাদবপুরে ‘হোক কলরব’ থেকে হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার মৃত্যু বিষয়ে ছাত্র রাজনীতি, দিল্লির নির্ভয়া থেকে কাঠুয়া অবধি মেয়েদের নিয়ে উত্তাল রাজনীতি, সাম্প্রতিক আইনগুলির জনপ্রিয়তাবাদী ঝোঁক— এক দিকে তথ্যের অধিকার আইনে জনগণের ক্ষমতায়ন ও অন্য দিকে তাকে ব্যবহার করে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির মারফত ৪০ লক্ষ মানুষকে নাগরিকত্বহীন করার চেষ্টা, রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে তামিলনাড়ুর জাল্লিকাট্টু থেকে স্টারলিট কোম্পানিকে ঘিরে জনপ্রিয়তাবাদী সংঘর্ষ— নানা বিষয়ে আলোচনা ও সংলাপ চলল সেখানে।
আলোচনার এই বিপুল বৈচিত্রই জানিয়ে দেয়, জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল তার কোনও নির্দিষ্ট বাঁধাধরা, অনমনীয় মতাদর্শ ও কার্যক্রম নেই। জনপ্রিয়তাবাদের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। বামপন্থীদের মতো একটি বা কয়েকটি শ্রেণি নয়, বা মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির মতো দু’একটি নিম্নবর্ণ নয়। সামগ্রিক ভাবে (অনেক সময়ই ধোঁয়াটে) মানুষ বা জনগণ বা পিপ‌্ল-এর নমনীয় ধারণা এই রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এই ধারণা পশ্চিমবঙ্গে বা তামিলনাড়ুতে যা, অসমে অবশ্যই অন্য। বস্তুত, সংজ্ঞা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন নমনীয়তার কারণেই আজকের দুনিয়ায় এই রাজনীতি এত দূর ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই নমনীয়তার ফলে, বাম, ডান বা মধ্যপন্থী— যে কোনও নেতা বা তাঁর রাজনীতিই এই গোত্রভুক্ত হতে পারে। মোদী বা ট্রাম্প যদি উগ্র জাতীয়তাবাদী বা দক্ষিণপন্থী মুখ হন, তবে উগো চাভেস বামপন্থী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ কেউ (নীতির দিক থেকে) বাম-ঘেঁষা জাতীয়তাবাদী।
এই আলগা মতাদর্শের পাশাপাশি থাকে কিছু জনমোহিনী স্লোগান। যেগুলি শুনতে বেশ, কিন্তু তলিয়ে ভাবলে তাদের নির্দিষ্ট মর্মার্থ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই জন্যই জনপ্রিয়তাবাদের তাত্ত্বিক, আর্জেন্টিনার উত্তর-মার্ক্সবাদী আরনেস্টো লাকলাউ এদের ‘ফাঁপা অর্থের বাহক’ (‘এম্পটি সিগ্নিফায়ার’) বলেছেন। ইন্দিরা গাঁধীর ‘গরিবি হটাও’, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা নরেন্দ্র মোদীর ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ এই রকম স্লোগান যা নির্দিষ্ট ভাবে জনগণের একটি অংশের কথা (যেমন, শ্রমিক শ্রেণি) বলে না, সেগুলি শুনে একই সঙ্গে নানা গোষ্ঠী বা শ্রেণির মানুষ মনে করে তাদের কথাই বলা হচ্ছে। অনেক সময় জনপ্রিয়তাবাদী নেতৃত্ব সমাজের কোনও অংশের বিরুদ্ধে বা ‘বাইরে থেকে আসা’ অভিবাসীদের (‘অনুপ্রবেশকারী’দের) বিরুদ্ধে শিথিল জনসমর্থন গড়ে তোলে। জনপ্রিয়তাবাদ তখন হয়ে যায় অপছন্দের সংখ্যালঘু মানুষের উপর ‘লোক-খেপানো’ রাজনীতির নামান্তর।
তবে কি আগামী দিনে এটাই আমাদের ভবিতব্য? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যখন শ্রেণি-রাজনীতি, এমনকি উদারপন্থী নাগরিক উদ্যোগগুলি ক্রমশই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে? জনপ্রিয়তাবাদ পুরনো সাংগঠনিক গণতন্ত্রের ধ্যানধারণার বদলে জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটা কিসের লক্ষণ? ভারতের মতো উত্তর ঔপনিবেশিক দেশে জনপ্রিয়তাবাদ কি পশ্চিমের মতোই চলবে, না কি তার কিছু অন্য মাত্রা আছে? সব চেয়ে বড় কথা, এই রাজনীতির সীমানা কত দূর? সেই সীমানা পেরিয়ে পূর্ণ গণতন্ত্র বা বামপন্থার প্রতি আকুতি থেকে যাওয়া দলগুলি যদি ফের ক্ষমতায় ফিরে আসে তবে কি তারা জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি ও তার অনুসৃত নীতিগুলি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারবে? সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে এখন এর উত্তর খোঁজাই সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Protest Movement Populist Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE