বাউড়িয়ার বাড়িতে সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার কফিন আঁকড়ে স্ত্রী ও মেয়ে। শনিবার। —ফাইল চিত্র।
বাউড়িয়ার বাসিন্দা মিতা সাঁতরা দেশের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে নাম লিখাইতে প্রস্তুত। কাশ্মীরে ৪৪ জন জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরমুহূর্ত হইতে যাঁহারা জঙ্গি বিক্রমে যুদ্ধের ভেরী বাজাইতেছেন, মিতা সাঁতরাকে তাঁহারা ভীরু বা দেশদ্রোহী বলিতে পারিবেন না। বলিতে না পারিবার আরও একটি কারণ আছে: তাঁহার স্বামী বাবলু সাঁতরা পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হানায় নিহত জওয়ানদের অন্যতম। এবং সেই কারণেই মিতার মন্তব্যে যুদ্ধবাদীরা নিশ্চয়ই অস্বস্তিতে পড়িবেন। তিনি বলিয়াছেন, যুদ্ধে এই সমস্যার সমাধান হইবে বলিয়া তিনি মনে করেন না। তাঁহার মতে, সরকারকে সমাধান খুঁজিতে হইবে, কিন্তু যুদ্ধের পথে নহে। যুদ্ধবাদীরা বলিবেন, সব নিহত জওয়ানের সব আত্মীয়স্বজন এই মত পোষণ করেন না। অবশ্যই করেন না। বস্তুত, বাউড়িয়ার এই শিক্ষয়িত্রীর মতটি তাঁহার অবস্থার প্রেক্ষাপটে হয়তো ব্যতিক্রমীই, তবে সম্পূর্ণ বিরল নহে— কার্গিল সংঘর্যে নিহত জওয়ানের কন্যা গুরমেহর কৌর যুদ্ধকেই ‘প্রকৃত শত্রু’ বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন। ব্যতিক্রমী হইলেও, এমনকি বিরল হইলেও, এই অবস্থান মূল্যবান।
মূল্যবান দুইটি কারণে। এক, ইহা সুস্থবুদ্ধির কণ্ঠস্বর। দুই, এই অবস্থান জানাইয়া দেয়, প্রগাঢ়তম ব্যক্তিগত বিপন্নতার মধ্যে দাঁড়াইয়াও কিছু মানুষ সুস্থবুদ্ধি বজায় রাখিতে পারেন, এবং সেই কারণেই মানবিক উত্তরণের সম্ভাবনা কখনও হারাইয়া যায় না। কাশ্মীরে পৈশাচিক সন্ত্রাস-কাণ্ডের পরে যে গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈয়ারি হইয়াছে, তাহাতে এই সুস্থবুদ্ধির প্রয়োজন অপরিসীম। কেবল যুদ্ধের জিগির নহে, উদ্বেগের আরও নানা কারণ রহিয়াছে। জম্মু ও দেহরাদূন সহ বিভিন্ন শহরে, এমনকি কলিকাতাতেও, কাশ্মীরের মানুষ আক্রান্ত বা সম্ভাব্য আক্রমণের নিশানা হইয়াছেন। কাশ্মীরি পণ্য বয়কটের কুডাক শোনা গিয়াছে। শান্তির কথা বলিতে গিয়া বহু নাগরিক কুৎসিত গালিগালাজ ও হুমকি শুনিয়াছেন। এই সব উদ্যোগ স্বতঃস্ফূর্ত নহে, ইহাদের পিছনে রহিয়াছে দুরভিসন্ধির ধারক ও বাহকদের সংগঠিত তৎপরতা, সমাজমাধ্যমে আক্রমণের চেহারা-চরিত্র দেখিলেই তাহা স্পষ্ট হইয়া যায়। এই ধরনের তৎপরতা যুদ্ধপরিস্থিতি অপেক্ষা কম বিপজ্জনক নহে। হিংস্র ঘৃণার বিধ্বংসী শক্তি আধুনিক পৃথিবী বার বার দেখিয়াছে। এ মহাভারতও সেই বিষাক্ত অভিজ্ঞতায় বিলক্ষণ অভিজ্ঞ। বিপদ প্রতিহত করিবার দায়িত্ব তাই প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এমন বিপদের মোকাবিলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করিবে, এমনটিই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। দুঃখের কথা, এবং দুশ্চিন্তার কথাও বটে, বর্তমান ভারতে সেই ভরসা যথেষ্ট পরিমাণে রাখা কঠিন। যাঁহারা রাষ্ট্র চালাইতেছেন, তাঁহাদের রাজনীতি প্রায়শই জঙ্গি অতিজাতীয়তাবাদকে মূলধন হিসাবে ব্যবহার করিয়া থাকে। কাশ্মীরের ঘটনার পরেও সেই দুর্লক্ষণ দেখা যাইতেছে। ক্ষমতাবানদের মুখে প্রতিশোধের হুমকি বা সেনাবাহিনীকে (জবাব দিবার) ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ প্রদানের ঘোষণা অশান্তির আশঙ্কা অনিবার্য ভাবে বাড়াইয়া তোলে। নির্বাচনের লগ্ন আসন্ন বলিয়াই উদ্বেগ আরও বেশি। নিরাপত্তার কাঠামো মজবুত করিতে সর্বতো ভাবে যত্নবান হওয়া জরুরি, যাহাতে পুলওয়ামার মতো ঘটনা আর একটিও না ঘটে। যাহারা এই সন্ত্রাসের কারিগর এবং যাহারা ইহার নেপথ্যে, তাহাদের পরিচয় উদ্ঘাটন করিয়া যথার্থ জবাব দেওয়াও অত্যন্ত জরুরি। সেই কাজ জঙ্গি স্লোগান এবং হুমকি দেওয়া অপেক্ষা অনেক বেশি কঠিন। রাষ্ট্রকেই তাহা করিতে হইবে। দেশের নিরাপত্তা, নিরাপত্তারক্ষীদের নিরাপত্তা রক্ষা করার দায়িত্ব পালনের জন্যও কিন্তু প্রয়োজন সামাজিক সুস্থিতির। উদ্ভ্রান্ত অথবা অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধবাদ সর্বদাই জাতীয় নিরাপত্তার বড় শত্রু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy