Advertisement
E-Paper

রক্তে যাদের দাসত্ব লেখা, ঋতুরক্তের মূল্য কী বুঝবে?

কোনও এক বাবা আদমের আমলে এই ‘শরীর খারাপ’ কথাটা চালু হয়েছিল। একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার কী করে ‘শরীর খারাপ’-এর পর্যায়ে পড়ে! বলিহারি আধুনিকাদেরও। লিখছেন সায়ন্তনী পূততুন্ড‘পিরিয়ড’-এর অর্থই যারা ঠিক মতো বোঝে না। তাদের অস্কারে কী আসে যায়! অস্কার তাদের জীবনে কি আদৌ ‘পিরিয়ড’ নামক অপবিত্র ছায়াকে পরিষ্কার করতে পারল?

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৯

অবশেষে ছোট ছবি ‘পিরিয়ড’ অস্কার জিতল!

সারা দেশ জুড়ে ধন্য-ধন্য চলছে। দেবতাগণ পুষ্পবৃষ্টি করার জন্য তৈরি। তোপ নিয়ে আমরা দাঁড়িয়েই আছি। গদাম-গদাম করে গোটা কয়েক দেগে দেব। সঙ্গে ‘রেকারিং ডেসিমালের’—‘ধ্যা-র‌্যা-র‌্যা-র‌্যা’! অস্কারবিজয়ী বলে কথা! একটু ধামাকা না হলে কি হয়?

কিন্তু এত কাণ্ডের পরেও সেই তোপধ্বনি, ধামাকা আর বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ পৌঁছবে না ওদের কানে! কারা? ওই যে, যাদের কাছে ‘পিরিয়ড’ মানে অসুখ! ‘পিরিয়ড’ মানে অপবিত্রতা! ‘পিরিয়ড’-এর অর্থই যারা ঠিক মতো বোঝে না। তাদের অস্কারে কী আসে যায়! অস্কার তাদের জীবনে কি আদৌ ‘পিরিয়ড’ নামক অপবিত্র ছায়াকে পরিষ্কার করতে পারল? পুরো দৃশ্যটা এক বার দেখে নেওয়া যাক। অস্কারের সোনালি ঝলকের পিছনের গল্পটা এক বার দেখি। আমেরিকা থেকে ভারতীয় নারীদের তৈরি হিন্দি ছবি ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স।’ এ বার সেরা ছোট তথ্যচিত্র হিসাবে অস্কার পেয়েছে। সুসংবাদ। কিন্তু পরিচালকের নাম দেখেই হেঁচকি তোলার উপক্রম। বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে উচ্চারণ করা গেল তাঁর নাম— রাইকা জেতাবচি! এক জন ইরানিয়ান-আমেরিকান পরিচালক! অদ্ভুত লাগে না? ভারতীয় মহিলাদের ঋতুস্রাবের সমস্যা নিয়ে তথ্যচিত্র শেষ পর্যন্ত এক ভিন্‌দেশি নারীকে করতে হল! তথাকথিত ‘নারীবাদী’ ভারতীয় মহিলা পরিচালকেরা কোথায় গেলেন? আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি না যে এই অস্কার ভারতের পক্ষে গৌরবের! এক বিদেশিনি জগতের সামনে ভারতের নারীদের দাঁড় করিয়ে প্রমাণ করে দিলেন কতটা গভীর অশিক্ষা, অন্ধত্ব ও কুসংস্কারে তারা ডুবে আছে!

কিন্তু এটাই হচ্ছে ভারতবর্ষের যথার্থ চিত্র। যতই আমরা আধুনিক হই, নারী দিবসে হই-হল্লা করি, সমানাধিকারের দাবীতে সরব হই— মেনস্ট্রুয়েশনের বিষয়টি এলেই সেই আধুনিকতার মাথায় বাজ পড়ে! তখন শিক্ষিত, সুন্দরী, আধুনিকারাও মুখে ডবল তালা এঁটে নেন! তার উপরে থাকে সংস্কারের শিলমোহর! জান যাক, তবু মুখ খুলব না, যেমন বেণী তেমনি রবে, চুল ভিজাব না-মার্কা অ্যাটিটিউড!

প্রত্যন্ত গ্রামেরর কথা ছেড়ে প্রথমে শহরের আধুনিকাদের প্রসঙ্গেই আসি। একটি ঘটনা না বলে পারা যাচ্ছে না! এক অত্যন্ত সুন্দরী শিক্ষিতা মা জিনস-টপ পড়ে কন্যাকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিতে এসেছেন। যদিও স্কুল ড্রেস না পড়া থাকলে কে মেয়ে আর কে মা তা বুঝে ওঠাই দায়! অবশ্য মেয়েটি একটু জড়োসড়ো। কথায় কথায় জানা গেল, তার প্রথম বার পিরিয়ড হয়েছে। এর মধ্যে কথা নেই বার্তা নেই, এক কাকু এসে পড়েছেন। তাঁর মেয়েও ওই স্কুলেই পড়ে। সেই কাকু মেয়েটির জবুথবু অবস্থা দেখে জানতে চাইলেন— ‘কী হয়েছে?’ মেয়ের মা একটু অস্বস্তি নিয়েই জানালেন— ‘শরীর খারাপ!’ কোনও এক বাবা আদমের আমলে এই ‘শরীর খারাপ’ কথাটা চালু হয়েছিল। একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার কী করে ‘শরীর খারাপ’-এর পর্যায়ে পড়ে, ভেবে পাই না! আর সেই কাকুও বলিহারি। তিনি বিবাহিত, তাঁর এক মেয়েও রয়েছে। ‘শরীর খারাপ’ শব্দটির সঙ্গে পরিচয় নিশ্চয়ই আছে। অথচ ভদ্রলোক টিন এজারের মতো গড়গড়িয়ে বলতে শুরু করলেন—‘কী হয়েছে? পেট ব্যথা? জ্বর! কাশি?...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন দেখলাম উনি প্রায় লেপ্রসি, টিউবারকিউলোসিস, ক্যানসারের দিকে এগিয়ে চলেছেন, মা আকাশের দিকে ঊর্ধ্বচক্ষু আর মেয়েটি মাটির সঙ্গে মিশতেই চলেছে, আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বলেই ফেললাম— ‘ওর পিরিয়ড চলছে’।

কাকু আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আমি এই মাত্র হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে দু’খানা অ্যাটম বোমা ফেলেছি! আর মায়ের মুখ দেখে মনে হল, এর চেয়ে মেয়ের ক্যানসার হলেই বোধহয় খুশি হতেন!

অবাক হবেন না। এটাই বাস্তব! পিরিয়ডের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে গেলে মনে হয় মিসাইল কিনছি! কারও অনিয়মিত পিরিয়ড হয় কিংবা পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যা থাকে, তবে তার ওষুধ কিনতে যাওয়া তো এক রকমের শাস্তি! কারণ এই জাতীয় সমস্যায় বহু গাইনোকলজিস্ট উন্নত মানের কনট্রাসেপটিভ পিল দেন। কেমিস্ট সেটির নাম শুনে এমন করে তাকাবেন, মনে হবে ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কবাদীকে দেখছেন!

এই হচ্ছে শহরের আধুনিকাদের অবস্থা! তা হলে এক বার ভাবুন মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া—কিংবা উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্র, রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের কী হাল? তাদের মানসিকতা কী? তথাকথিত ‘প্যাডম্যান’ অরুণাচলম মুরুগানন্থমের প্রবল লড়াই এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য দেয়। এক জন পুরুষ মেয়েদের ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন’-এর জন্য লড়ে যাচ্ছেন, অথচ মেয়েরাই তাঁকে গালিগালাজ করেছে সবচেয়ে বেশি! ‘পিরিয়ড’ মানেই তারা জানে না— মেনস্ট্রুয়াল হাইজিনের তো নিকুচি করেছে। যেখানে নারীরা নিজেরাই জানে না যে এই রক্তপাত আসলে একটি পবিত্রতম সৃষ্টির সূত্রপাত, কোনও অসুখ নয়—সেখানে অস্কারের সাধ্য নেই তাদের ‘হাইজিন’ বোঝানোর। কিছু দিন আগেই এক ঋতুমতী কিশোরীর ব্যবহৃত কাপড়ে জোঁক ঢুকে যাওয়ায় তার মর্মান্তিক মৃত্যুও এই বন্ধ আর অন্ধ চোখগুলোকে খোলাতে পারে না!

আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে ভারতীয় নারীরা নিজেরাই নিজেদের ক্রমাগত ছোট করে চলেছে! ইতিহাস সাক্ষী, সতীদাহ থেকে বাল্যবিবাহ রদ, স্ত্রী শিক্ষা থেকে বিধবা বিবাহ প্রচলন অবধি সব কাজেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর বা বেথুন সাহেবদের এগিয়ে আসতে হয়! নারীরা চোদ্দ পুরুষের গুষ্টির তুষ্টি করলেও ‘প্যাডম্যান’-কেই ‘মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন’ সম্পর্কে প্রচার চালাতে হয়। যাদের রক্তেই বহু শতাব্দীর দাসত্ব লেখা হয়ে গিয়েছে, তারা নিজেদের রক্তের মূল্য কি কোনও দিন বুঝবে?

সুখবর হল, মূল্যটা নদিয়া কিছুটা আগে হলেও বুঝেছে। ‘পিঙ্ক ফ্ল্যাগ’ আন্দোলনের মাধ্যমে স্কুলছাত্রীদের ঋতুচক্র ও ঋতুকালীন সুস্থতার উপরে আলোকপাত করা হচ্ছে। কিন্তু বাকি জেলাগুলো? সবচেয়ে বড় কথা সরকার এবং আমজনতা? তাদের চোখই বা কবে খুলবে?

সঙ্গে ‘পিরিয়ড। এন্ড অফ সেনটেন্স।’ তথ্যচিত্রের একটি দৃশ্য।

লেখক সাহিত্যিক

Period. End of Sentence. Documentary Shprt Film Period OSCARS
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy