Advertisement
E-Paper

নির্বাচনে তবে কার জয় হল

দুই সতীর্থ সাংবাদিক এ বার গুজরাতের গাঁ-গঞ্জ ঘুরেছেন নিবিড় ভাবে। দু’জনেই অমদাবাদ শহরে ফিরে এসে বলেছিলেন, গোটা রাজ্যের মানুষ ফুঁসছে। নোট স্থগিত থেকে জিএসটি-র প্রভাব, রাজ্যের ছোট-বড়-মাঝারি সর্ব স্তরের ব্যবসায়ী ক্ষুব্ধ।

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:২৪
বিজয়ী: গুজরাত বিধানসভায় বিজেপির জয়ের পর নরেন্দ্র মোদী। উন্নয়ন নয়, নির্বাচনের প্রচারপর্বে শোনা গেল শুধুই বিদ্বেষের সুর। ছবি: পিটিআই

বিজয়ী: গুজরাত বিধানসভায় বিজেপির জয়ের পর নরেন্দ্র মোদী। উন্নয়ন নয়, নির্বাচনের প্রচারপর্বে শোনা গেল শুধুই বিদ্বেষের সুর। ছবি: পিটিআই

গণতন্ত্রে সাংবিধানিক পরীক্ষা হল ভোট। সেই ভোটে জয়-পরাজয়ের তত্ত্ব অনুসারে সংখ্যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে ২২ বছর পরেও এই সংখ্যার জোরে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপি ষষ্ঠ বারের জন্য রাজ্যপাট দখলে রেখেছেন। কোনও ক্রমে পাশ করলেও বলতেই হবে, শাবাশ! সাফল্যের মতো সফল আর কী? কিন্তু এ বারে গুজরাতে যে রাজনীতি যে কৌশলে যে সংখ্যা পেয়ে বিজেপি জিতল, তাতে জয়ী হলেও আপনি কি খুশি, মোদীজি?

দুই সতীর্থ সাংবাদিক এ বার গুজরাতের গাঁ-গঞ্জ ঘুরেছেন নিবিড় ভাবে। দু’জনেই অমদাবাদ শহরে ফিরে এসে বলেছিলেন, গোটা রাজ্যের মানুষ ফুঁসছে। নোট স্থগিত থেকে জিএসটি-র প্রভাব, রাজ্যের ছোট-বড়-মাঝারি সর্ব স্তরের ব্যবসায়ী ক্ষুব্ধ। চাষিরা বিদ্রোহী। পটেলরা অসন্তুষ্ট। ভোটারদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, এ হল প্রকৃতির সূত্র। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী তো নির্বাচনের প্রধান মুখ ছিলেন না— সেই ভূমিকায় ছিলেন নরেন্দ্র মোদীই। ভোটের ফল যা-ই হোক, রাহুল কিন্তু মোদীর ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত মোদী-শাহের জয় হলেও প্রশ্ন থেকে যায়, এ জয় কি গণতন্ত্রের জয়? মনে হচ্ছে এটা সাম্প্রদায়িকতার জয়। ভোটের ফলাফলের নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপির টীকা-ভাষ্যকাররা বলছেন, এ হল মোদীর জাদু। পটেল বিদ্রোহে অ-পটেল জাতিগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ ভাবে বিজেপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পটেল-তফসিলি-মুসলিম জনসমাজ সকলেই শেষ পর্যন্ত একত্রিত হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি।

মোদ্দা কথাটা হল, গুজরাতের ভোটারদের কাছে যে ভাবে প্রচারে মোদী প্রধানমন্ত্রী পদের মর্যাদা খুইয়ে, বিকাশ ভুলে, হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের রাজনীতি করলেন, মনমোহন সিংহকে পাকিস্তানের চর বলা হল, রাহুল গাঁধীকে বাবরের বংশধর থেকে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করা হল, তাতে বোঝাই গিয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতাই মোদী-শাহর প্রধান রাজনৈতিক তাস। বলতেই পারেন, এ বার ভোটে মোদী বাবর থেকে আওরঙ্গজেব, মুঘল সম্রাটদের পরাস্ত করেছেন!

গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের জন্য এ বড় দুঃসময়। ভোটে মোদী জিতেছেন, কিন্তু রাজ্যের এক বড় অংশের মানুষের মন জয় করেছেন রাহুল। অমিত শাহ নিজেও ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করেছেন, এ বার ভোটে রাহুল খুব পরিশ্রম করেছেন। আমারও মনে হয়েছে, সাধারণ মানুষের ধারণা হয়েছে, মোদীর মধ্যে নাটক থাকলেও রাহুল আন্তরিক। এই রাজনীতির স্বাদ গুজরাতের মানুষ আগে পায়নি।

আসলে এই ভোটের ফল হল, গুজরাতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় উন্মাদনা। এ-ও এক ধরনের নিবৃত্তি আর প্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব। প্রবৃত্তি বলছে, আমি হিন্দু। সংকীর্ণ হিন্দু। নিবৃত্তি বলছে, এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।

এই সংকীর্ণ সত্তাই তো গোধরা কাণ্ডের কুশীলব। রাজনৈতিক প্রভুর অঙ্গুলিহেলনে এই প্রবৃত্তিই তো সে দিন আগুন লাগিয়েছিল। তাই সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বিজেপির জয় বহু মানুষের ‘প্রেয়’, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য ‘শ্রেয়’ কি? গণতন্ত্র কিন্তু সংখ্যালঘুর অগ্রাধিকারকে সুরক্ষিত করে। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের স্টিম রোলার নয়।

গণতন্ত্রের এই দুঃসময়ের কাহিনি আজ বিশ্ব জুড়েই। ১৯৯২ সালে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা লিখেছিলেন, বার্লিনের প্রাচীর ১৯৮৯ সালে ভেঙে পড়ার পর কমিউনিজমের মৃত্যু হয়েছে, উদার গণতন্ত্রই পৃথিবীর ইতিহাসে শেষ কথা, সেখানেই ইতিহাসের পরিসমাপ্তি। ফুকুয়ামার এই ভাবনাও যে শেষ কথা নয়, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদী হামলার পরও ফুকুয়ামার বিশ্বাসভঙ্গ হয়নি। কারণ, ইসলামিক মৌলবাদ যে উদার গণতন্ত্রের বিকল্প হতে পারে না, বিশ্ববাসী যে সেটা মেনে নিতে পারে না, সেটা ছিল ফুকুয়ামার দৃঢ় বিশ্বাস।

তবে ট্রাম্পের বিজয়ের পর উদার গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও বিশ্ব জুড়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড অভিধান ‘পোস্ট ট্রুথ’ (উত্তর-সত্য) নামক শব্দটিকে ঠাঁই দিয়েছে। তারা বলেছে এই শব্দটি অভিধানে ছিল, তবু এই শব্দটাই ২০১৬ সালে এ বছরের প্রধান শব্দ। শব্দটার মানে কী? মানে হল, যে সময়ে বস্তুগত তথ্য জনমত গঠনে প্রভাব ফেলছে না, যা সত্য নয় তা মানুষের বিশ্বাস অথবা আবেগ হয়ে জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

ব্রেক্সিটের গণভোটেও তো এমন কাণ্ড হয়েছিল যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বদলাতে হল। এখন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমীক্ষায় বলছেন, ভুল করেছি।

আজ মোদী-যুগে ভারতের জনসমাজেও তো দেখছি এক ভয়াবহ অসত্যের প্রচার। গুজরাতের ভোটেও সেই উত্তর-সত্য ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির পরিচয় পেলাম। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ছে। সবচেয়ে দুঃখ তার, যে আলোকের মধ্যে থেকেও চোখ বুজে আছে, যার চারিদিকে আঁধার নেই, যে আপন আঁধার আপনি সৃষ্টি করে বসে আছে। ভুলে যাব না, হিটলারের জনসভাতেও একদা দেখা গিয়েছে মানুষের ঢল। মোহ নামক জিনিসটা বড় ভয়ানক। সমস্ত রিপুর কেন্দ্রস্থলে থাকে এই মোহ, এই অজ্ঞানের আবেশ, এই জড়তা, এই অন্ধ আসক্তি থেকে মুক্ত না হতে পারলে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারত গঠিত হবে না। ধর্ম হবে সাম্প্রদায়িক দাম্ভিকতা।

গুজরাত সম্পর্কে একটা কথা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই। ১৯৬০ সালে ভাষার ভিত্তিতে বোম্বাই প্রদেশ ভেঙে গুজরাত এক পৃথক নতুন রাজ্য হল। নতুন রাজধানী গাঁধীনগর তৈরি হয়। আর ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখি গাঁধীর গুজরাত প্রান্তে স্বাধীনতার আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও দাঙ্গার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৭৯৫ সালেও গুজরাতের সুরাতে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। এই ধর্মমোহের তামসিকতা থেকে ভারতকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন নেহরু এবং এই উপমহাদেশের সেই অর্ধনগ্ন ফকির, মহাত্মা গাঁধী।

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে এক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর এখন আপনার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী? তখন সবে দেশের নতুন সংবিধান রচনা হয়েছে। দরিদ্র দেশ ভারত নানা আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। তবু মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান নেহরু। তার পর তিনি বলেছিলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ একটা ধর্মপ্রবণ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলা। ওটা হলে বাকি সব হয়ে যাবে।

কাজটা যে কত কঠিন, তা তো এই ২০১৭ সালে গুজরাত বিধানসভার ভোটের চরিত্র দেখেও বোঝা যাচ্ছে। তাই বিজেপি জিতলেও মনে হচ্ছে, এ হল সাম্প্রদায়িকতার জয়। রাজ্যের ভয়াবহ আর্থিক পরিস্থিতি, গুজরাত মডেলের কল্পনা-বিলাস, ‘অচ্ছে দিন’-এর ভ্রমও যে দূর হচ্ছে মানুষের মন থেকে, সেও এক নবীন আশা। রাহুল গাঁধী বলেছেন, তিনি এই রাজনীতির ভাষ্য বদলাবেন। রাহুলের পিঠে এখন অনেক চ্যালেঞ্জের বোঝা!

Narendra Modi নরেন্দ্র মোদী BJP Gujarat Assembly Election 2017 Congress Rahul Gandhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy