সুপ্রিম কোর্টে একটি প্রশ্নের উত্তর মিলিল— পঞ্চায়েতে যে আসনগুলিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফয়সলা হইয়াছে, একলপ্তে তাহা বাতিল হইতেছে না। শীর্ষ আদালতের মতটি তাৎপর্যপূর্ণ। এতগুলি আসনে নির্বাচন খারিজ করিতে হইলে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয়, তাহার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ বাদীপক্ষ আদালতের নিকট পেশ করিতে পারে নাই। আদৌ সেই প্রমাণ পেশ করা সম্ভব কি না, তাহা ভিন্নতর প্রশ্ন। কিন্তু, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিচারবিভাগের ক্ষমতা যে শেষ অবধি সীমাবদ্ধ, এবং তাহার পক্ষে পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনের ন্যায় শাসন-প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করা ভিন্ন উপায় নাই, তাহা স্পষ্ট হইয়া গেল। পাশাপাশি, এই রায় জন্ম দিল বেশ কয়েকটি প্রশ্নের। প্রথম প্রশ্নটি আদালতের প্রতি। মাননীয় বিচারকদের উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও জানিতে চাওয়া প্রয়োজন, মামলাটি যে আদৌ গ্রহণযোগ্যই নহে, এই কথাটি জানাইতে এত দিন সময় লাগিল কেন? তিন মাস পরে যে কথাটি বলা হইল, অর্থাৎ নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অভিযোগ থাকিলে তাহা ইলেকশন পিটিশনের মাধ্যমেই করিতে হইবে, এই কথাটি কি গোড়াতেই বলিয়া দেওয়া যাইত না?
দ্বিতীয় প্রশ্নটি বিরোধীদের উদ্দেশে। কোন (আইনি) লড়াই কী ভাবে লড়িতে হয়, সেটুকুও না জানিলে কি আদৌ জেতা সম্ভব? আদালত কোনও নূতন কথা বলে নাই, পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনের একটি ধারা স্মরণ করাইয়া দিয়াছে মাত্র। সেটুকুও কি জানিয়া লওয়া যাইত না? বিরোধীরা একটি বৃহত্তর প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারেন। বলিতে পারেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া রাজ্যে এমনই পরিস্থিতি সৃষ্টি হইয়াছিল, নির্বাচন কমিশন অবধি এতটাই পক্ষপাতপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করিয়াছিল যে সুপ্রিম কোর্ট ব্যতীত অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা করা সম্ভব হয় নাই। ইহা রাজনৈতিক যুক্তি হইতে পারে, কিন্তু আদালতে সেই যুক্তি অচল। আদালত আইনের বাঁধিয়া দেওয়া পথে হাঁটিতে দায়বদ্ধ। উত্তরোত্তর আদালত-নির্ভর বিরোধী রাজনীতি এই উদাহরণটি স্মরণে রাখিতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি ভরসা হারাইয়া ফেলা সহজ। তাহাদের নিরপেক্ষতার পথে ফিরিতে, দায়িত্ব পালন করিতে বাধ্য করা তুলনায় কঠিনতর। কিন্তু, সেই কঠিন পথে চলাই বিরোধী রাজনীতির কাজ।
তৃতীয় প্রশ্নটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি। মামলার শুনানি চলাকালীন আদালতের পর্যবেক্ষণ এবং শুক্রবারের রায়ের মধ্যে যে পার্থক্য, তাহা নিশ্চিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর নজর এড়ায় নাই। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় পচন ধরিয়াছে, এ হেন কড়া মন্তব্যের পরও আদালত যখন মামলাটি খারিজ করিয়া দেয়, তাহার তাৎপর্য কী? কেহ বলিতেই পারেন, যে আসনগুলিকে কেন্দ্র করিয়া বিরোধীদের অভিযোগ, প্রশাসনিক স্তরে তাহার সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগৃহীত হয় নাই বলিয়াই আদালতের নিকট আর কোনও উপায় ছিল না। অভিযোগ উঠিতেই পারে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন এত বেশি দলীয় আনুগত্য প্রকাশে ব্যস্ত ছিল যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে, অথবা ত্রুটিবিচ্যুতির খতিয়ান রাখিতে তাহাদের আগ্রহ ছিল না। সকলই অভিযোগ, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিবেন, সেই অভিযোগ সারবত্তাহীন নহে। মামলাটি খারিজ হইয়া গেল বলিয়াই মুখ্যমন্ত্রী দায়মুক্ত নহেন। বরং, তাঁহার দায়িত্ব আরও বাড়িল। রাজ্যে গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষার দায়িত্বটি যে প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার উপরই বর্তায়, কথাটি তিনি বুঝিয়া লউন। মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছিল এই মামলায়। সংখ্যাটি এমনই বিপুল যে তাহার গুরুত্ব অস্বীকার করিবার কোনও উপায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাই। দলীয় নেত্রী হিসাবে নহে, মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হউন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy