Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আমরা কেন পিছিয়ে থাকি

মুর্শিদাবাদের এক মাস্টারমশাই বললেন, ‘হিন্দুর বিয়ে যেমন প্রজাপতি নির্বন্ধ সাত জন্মের বন্ধন, মুসলমানের বিয়ে কিন্তু তা নয়। আমাদের বিয়ে মূলত সামাজিক এবং পারিবারিক লিখিত চুক্তি।

মিলন দত্ত
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share: Save:

তা লাক ব্যবস্থাটাই কি উঠে গেল? গাঁয়ে তো সেই রকমই কথা হচ্ছে। বিবিকে ছাড়ান দিতে কি এখন আদালতে যাওয়া ছাড়া উপায় রইল না? সে ভালই হয়েছে, পুরুষগুলা আর ইচ্ছেমত বউদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না। যাক, তাও অনেক নিশ্চিন্তি হওয়া গেল।’— তিন তালাক (তালাক-এ-বিদ্দত) ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের রায় দেওয়ার পর থেকে এমনই সব কথা চলছে গ্রামে গ্রামে মুসলমান সমাজে, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে। সঙ্গে আরও একটা কথা পুরুষ মহলে ভীষণ ভাবে ছড়িয়েছে: ‘মোদী সরকারের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট এই ‌রায় দিয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে মুসলমানের নিজস্ব পারিবারিক আইন বিলুপ্ত করার এক জঘন্য প্রয়াস।’

পুরুষ যা-ই বলুক, মেয়েরা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এক ধরনের সক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করেছেন। তাঁরা বুঝেছেন শরিয়তের নাম করে তাকে যতই দমন করার চেষ্টা হোক, দেশের বিচারব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা এখন পুরুষের সমান অধিকারের দাবি নিয়ে শরিয়তের পরিসরের বাইরে পা ফেলতে চাইছেন। বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা সোনাভান মামলা করে খোরপোশ আদায় করেছেন। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও খোরপোশের টাকা তো দেয়ই না, উলটে সেই বীরপুঙ্গব আর একটা বিয়ে করেছে। গত ছ’বছর ধরে মামলা চালাতে চালাতে জেরবার ওই মেয়ের অভিযোগ, আদালতের নির্দেশ আছে, তাও পুলিশ তার অভিযুক্ত স্বামীর কাছ থেকে খোরপোশ আদায় করা বা সেই টাকা আনাদায়ের জন্য তাকে গ্রেফতার করার কোনওটাই করে না। সোনাভানের প্রশ্ন, মামলা চলাকালীন ছেলেরা যদি বিয়ে করতে পারে তা হলে মেয়েরা পারবে না কেন?

এই ভাবে গ্রাম-গঞ্জের বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষিত মানুষ সুপ্রিম কোর্টের রায়টিতে খুশি। কেন? অন্যান্য দেশ যখন শরিয়ত আইন কমবেশি সংস্কার করে মানুষের জীবন, বিশেষত মেয়েদের জীবনকে সহনীয় করেছে, তখন ভারতীয় মুসলমান সমাজের অচলায়তনে এই ধাক্কা তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে। তিন তালাক প্রথার বিলুপ্তি তার নাগালে এনে দিয়েছে বহুবিবাহ এবং নিকা হালালা প্রথা বিলোপের আশা। মহিলা সংগঠনগুলো এত দিন মুসলিম মেয়েদের অধিকারের দাবিতে সরব ছিল, এখন বাংলার সাধারণ নারীর মুখেও সেই উচ্চারণ। তিন তালাকের নামে বধূ নির্যাতনের যে আয়ুধ এত দিন পুরুষ অবাধে ব্যবহার করেছে, আদালতের রায়ে সেটা এখন ভোঁতা। ভারতীয় মুসলমান নারী এটা অর্জন করেছে দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। এই অর্জন তাকে এতটাই প্রত্যয়ী করেছে যে গ্রামে গঞ্জে মোল্লা-মৌলানাদের বিরোধী প্রচার আর হুমকিতে তারা ভয় পাচ্ছে না।

নদিয়ার গ্রামের তালাক পাওয়া মেয়ে বিলকিস শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত হয়ে থানায় গিয়েছিলেন ৪৯৮এ ধারায় স্বামী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে। ‘মুসলমানের নিজেদের আইন আছে যা করার সেখানেই করো গিয়ে’— এই অজুহাতে বিলকিসকে ফিরিয়ে দেয় থানা। মৌলানা-মুফতিদের দাবি, কোরান আর শরিয়তে রয়েছে মানুষের সব সমস্যার সমাধান। বিলকিস ওই ধর্মীয় নেতাদের দ্বারস্থ হয়ে কেবল বাড়তি লাঞ্ছনাই পেয়েছেন। তারা বিলকিসের তালাক নিশ্চিত করে শ্বশুর বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করেছে। এখন বিলকিস ভাবছেন, তাঁকে না হয় স্বামী তালাক দিয়ে ছেলেমেয়ে সুদ্ধ ঘর থেকে বের করে দিয়েছে, আর কোনও মেয়ের অন্তত সে দশা হবে না। কোর্টের রায়ের পর এ বার অন্তত ৪৯৮এ ধারার মামলা করতে গেলে পুলিশ মুসলমান মেয়েদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। মুফতি-মৌলানাদের জারিজুরি এ বার শেষ হবে। তিন তালাকের আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তা আমাদের সমাজে মুসলমান মেয়েদের ভয়ানক এক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রাখে, আদালতের রায় বোধহয় তাদের খানিকটা নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে পেরেছে। তবে আরও চাই। ডোমকলের রেহানার মত, পুরুষের মতো মেয়েদেরও তালাক দেওয়ার সমান অধিকার দিতে হবে। তিনি এখানেই থামেননি, মুসলমান মেয়েদের বিয়ের বয়স এ বার ১৫ থেকে বেড়ে ১৮ হবে বলেও আশা তাঁর। তালাকের সঙ্গে জড়িত নিকা হালালা প্রথারও অবসান চান তাঁরা।

মুর্শিদাবাদের এক মাস্টারমশাই বললেন, ‘হিন্দুর বিয়ে যেমন প্রজাপতি নির্বন্ধ সাত জন্মের বন্ধন, মুসলমানের বিয়ে কিন্তু তা নয়। আমাদের বিয়ে মূলত সামাজিক এবং পারিবারিক লিখিত চুক্তি। সেখানে মৌলানার চেয়ে কাজির ভূমিকা অনেক বড়। তার সঙ্গে ধর্মের অনুষঙ্গ সামান্যই।’ ইতিহাসের ওই শিক্ষক মনে করেন, এ বার সময় এসেছে চোদ্দোশো বছরের পুরনো মুসলিম পারিবারিক আইনের সংস্কার করে তালাকের ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের বিষয়টা বিবোচনা করা হোক। শরিয়তের পরিসরের মধ্যে সম্ভব না হলে দেশের সংবিধান মেনেই তৈরি হোক আইন, যেখানে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। তাতে বিজেপি বা মোদীর সরকার জিতে যাবে না, বরং জয় হবে ভারতীয় মুসলমানের আর ইসলামের নমনীয়তার।

এ রাজ্যে মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল অংশ তো বটেই, শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত পুরুষদের অনেকেও তালাককে বড় কোনও সমস্যা বলে মানতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে তালাক নেই বললেই চলে। মুসলমান সমাজে তালাকের চেয়ে অনেক বড় শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের মতো সমস্যা রয়েছে। তালাকের মতো একটা ছোট সমস্যাকে অকারণ গুরুত্ব দিয়ে বড় সমস্যাগুলো আড়ালে ঠে‌লে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তা ছাড়া তালাক প্রসঙ্গ বড় করে দেখিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে এক দল লোক। তালাকের সমস্যা তাই মুসলমান সমাজে নিতান্তই মেয়েদের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত পুরুষদের নীরবতা বা দ্বিধা তাঁদের কার্যত তিন তালাকের পক্ষেই দাঁড় করিয়েছে। অথচ ২০১১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট বলছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে স্বামী পরিত্যক্তা এবং তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ৯.৬ শতাংশ। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড রাজ্যের আট হাজার পরিবারের তথ্য নিয়ে ২০১৪ সালে করা সমীক্ষা অনুযায়ী মুসলিম মহিলাদের ১.৩ শতাংশ বিবাহবিচ্ছিন্না। মনে রাখতে হবে তিন তালাক মুসলমানদের একটি মজহাব বা খণ্ডসম্প্রদায় (হানাফি)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সব জেলায় তালাক দেওয়ার প্রবণতার তারতম্য রয়েছে। সর্বোপরি তিন তালাকের ঘটনা সবচেয়ে বেশি অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল, পিছিয়ে-থাকা এবং শিক্ষাহীন পরিবারে। আবার যে সব অঞ্চলে মেয়েরা উপার্জনশীল, সেখানেও তিন তালাকের ঘটনা কম।

কিন্তু এ সব সংখ্যা দিয়ে তিন তালাকের মতো পুরুষতান্ত্রিক অমানবিক কদর্য সামাজিক প্রথার বিচার করা উচিত না। তাকে বিচার করতে হবে তালাক পাওয়া নারীর প্রতি দিনের যন্ত্রণা অপমান এবং নিরাপত্তাহীনতার নিরিখে। সুপ্রিম কোর্ট সেটা করেছে। তালাক কম হয় না বেশি, সেটা বিবেচ্য নয়, দেশে যদি একটাও তিন তালাক বা তাৎক্ষণিক তালাকের ঘটনা না ঘটে, তার পরও একটা মধ্যযুগীয় বর্বর রীতি সমাজে টিকিয়ে রাখা হবে কোন যুক্তিতে? শুধুমাত্র সেটা চোদ্দোশো বছর আগে কোনও খলিফা প্রবর্তন করেছিলেন বলে এবং অষ্টম শতকে ইরাকের ইমাম আবু হানিফা তার অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে? বিশ্বাসীরা জানেন, কোরানের মতো শরিয়ত কোনও কিতাববদ্ধ অলঙ্ঘনীয় ঐশী বাণী নয়। কোরানের নির্দেশ এবং তত্ত্ব অনুসরণ করে কিছু ধর্মবেত্তা শরিয়ত বা ইসলামি আইন গড়েছিলেন। একই ভাবে আজ দেশের ইসলামি পণ্ডিতরা তার প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে পারেন। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ সমেত বহু মুসলিম দেশে সেই সংস্কারের কাজ ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। এখনও হয়ে চলেছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE