Advertisement
E-Paper

গৌরবে একবচন

বিজেপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কয়েকটি অনতিজটিল সমীকরণ আছে। প্রথম, সরকার এবং রাষ্ট্র এক ও অভিন্ন। দ্বিতীয়, রাষ্ট্রের বৃহত্তম প্রতীকটির নাম সেনা। যে জাতীয়তাবাদ পেশি আস্ফালনে বিশ্বাস করে, সেনার বাহুবলের আকর্ষণ তাহার নিকট অমোঘ।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৩

হাল্লা রাজার সেনা ছিল। নরেন্দ্র মোদীর যে তাহা নাই— ভারতীয় সেনা যে মোদী বা তাঁহার সরকারের সম্পত্তি নহে— এই কথাটি যোগী আদিত্যনাথরা বোঝেন নাই। বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারের রচয়িতারাও বোঝেন নাই। এমনকি, সম্ভবত স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীও বোঝেন নাই। ফলে, বিজেপির নির্বাচনী প্রচারে বারে বারেই সেনার প্রসঙ্গ আসিতেছে। কখনও আদিত্যনাথ ভারতের সেনাবাহিনীকে মোদীজির সেনা আখ্যা দিতেছেন। আবার কখনও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ভোটভিক্ষা করিতেছেন বালাকোট আক্রমণের নামে, পুলওয়ামার শহিদদের নামে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্তারা এই রাজনীতিতে আপত্তি জানাইলে তাঁহাদের হরেক কিসিমে আক্রমণ করিতেও বিজেপির দ্বিধা নাই। বিরোধীরা হয়তো বলিবেন, বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী সন্ত্রস্ত এবং মরিয়া বলিয়াই নির্বাচন কমিশনের আপত্তিতেও থামেন নাই। কথাটি ভুল নহে। কিন্তু অতিসরলীকৃত। ধরা যাক, এই নির্বাচনে যাঁহারা প্রথম বার ভোট দিবেন, তাঁহারা ভোটগুলি সত্যই বালাকোটের বায়ুযোদ্ধাদের উৎসর্গ করিলেন। কিন্তু, তাঁহারা যে পদ্মফুলে বোতাম টিপিবেন, সেই নিশ্চয়তা মোদী পাইলেন কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান না করিলে বোঝা যাইবে না, কেন বিজেপির প্রচারে সেনা বিনা গীত নাই।

বিজেপির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কয়েকটি অনতিজটিল সমীকরণ আছে। প্রথম, সরকার এবং রাষ্ট্র এক ও অভিন্ন। দ্বিতীয়, রাষ্ট্রের বৃহত্তম প্রতীকটির নাম সেনা। যে জাতীয়তাবাদ পেশি আস্ফালনে বিশ্বাস করে, সেনার বাহুবলের আকর্ষণ তাহার নিকট অমোঘ। প্রথম দুইটি সমীকরণের অনিবার্য সিদ্ধান্ত, সরকার— অথবা, গৌরবার্থে একবচন ব্যবহার করিলে, নরেন্দ্র মোদী— এবং সেনাবাহিনী অবিচ্ছেদ্য। গত পাঁচ বৎসরে বিজেপির প্রচার যত বার সেনাকে মহিমান্বিত করিয়াছে, শুধুমাত্র সেই মহিমাকে নিজেদের উপর প্রতিফলিত করিবার বাসনাতেই। বিজেপি যদি একটিমাত্র কথা প্রতিষ্ঠায় প্রাণপাত করিয়া থাকে, তবে তাহা এই— যে গৌবর সেনার, তাহা স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই নরেন্দ্র মোদীর। প্রাক্তন সেনাকর্তারা যখন এই জবরদখলে আপত্তি জানাইয়া পত্রাঘাত করিলেন, তাহার বৈধতা কাড়িতে বিজেপির অত্যুৎসাহ প্রমাণ করিল, তাঁহাদের বিশ্বাস-ব্যবস্থায় সেনার ধারণার সহিত প্রকৃত সৈনিকদেরও যোগ নাই— তাঁহাদের নিকট সেনা শুধু রাজনৈতিক আয়ুধ। ‘এই সেনা মোদীজির’। আদিত্যনাথ শুধু কথাটি বলিয়া ফেলিয়াছেন। নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করিবার বিদ্রোহী বাসনায় নহে, ইহা অন্তরের বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। নরেন্দ্র মোদীও যখন সেনার নামে ভোট চাহিয়াছেন, তখন বিশ্বাস করিয়াছেন— তিনি আর সেনা প্রকৃত প্রস্তাবে অদ্বৈত।

বিশ্ব-ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে, যে কোনও সর্বাধিপত্যকামী শাসকেরই সেনাবাহিনীর প্রতি সুতীব্র মোহ থাকে। মোদীরও আছে। এই মোহের খানিক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত— খাকি হাফপ্যান্ট পরিয়া কুচকাওয়াজের সঙ্ঘীয় অভ্যাসটির কথা স্মর্তব্য। আবার, খানিক নিজেদের রাজনীতির প্রয়োজনে। তাঁহাদের রাজনীতি যে ‘নেশন’-এর সাধনা করে, তাহার কেন্দ্রস্থলে সর্বজনীনতা নাই, বর্জন আছে। তাঁহাদের আত্মের ধারণাটি দাঁড়াইয়া আছে অপর-এর ধারণার উপর। ফলে, যে ‘নেশন’-এর মূল চালিকাশক্তি বৈর, তাহাকে শক্তির ভাষাতেই কথা বলিতে হয়। দমন করিবার শক্তি, ধুলায় মিশাইয়া দেওয়ার শক্তি। ঘরের শত্রুকেও, বাহিরের শত্রুকেও। এই শক্তি-সাধনার বৃহত্তম প্রতীক যে সেনাবাহিনীই হইবে, তাহাতে সংশয় কী? অতএব, তাঁহারা সেনাবাহিনীকে গণতান্ত্রিকতার বাড়া মর্যাদা দিয়াছেন। তাহা কি শুধুই অন্যান্য অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে? তাঁহারা কি সত্যই ভাবেন না, সেনা নামক বজ্রমুষ্টিতে শুধু বাহিরের শত্রু নহে, অভ্যন্তরের শত্রুকেও দমন করিতে পারাই রাষ্ট্রের বৃহত্তম সাফল্য?

BJP Indian Army Nationalism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy