Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ছলনার স্পর্ধা

কুনাট্য আরও জমিয়া উঠিল যখন প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত লইলেন, বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকী ও দীনদয়াল উপাধ্যায়ের শতবার্ষিকী পালিত হইবে একই সঙ্গে।

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:২২
Share: Save:

ভারতের পতন ও অবনতির প্রধান কারণ: হিন্দু জাতির চারি দিকে আচারের বেড়া দেওয়া, অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করা।— যাঁহার মুখ হইতে এমন কথা নিঃসৃত হইয়াছিল, তিনি আর যাহাই হউন, বিজেপি বা আরএসএস-এর আইকন হইতে পারেন না বলিয়াই সাধারণ বোধ বলে। কিন্তু তিনি কী বলিতেন, কী ভাবিতেন, তাহা সত্য ও যথার্থ ভাবে দেশবাসীকে জানাইবার দরকার কী! বরং সভা সমাবেশে গলা ফাটাইয়া বলিলেই তো হয় যে এই মানুষটিই বিজেপির আদর্শ পুরুষ, তাঁহার পতাকাই আজকের ভারতের বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রত্যহ বহিতেছেন! সাধারণ মানুষ তো বইপত্র খুলিয়া সত্য মিথ্যা মিলাইয়া দেখিবে না, আর মিথ্যাভাষণ যতক্ষণ না ধরা পড়ে, সে তো এক প্রকার মহাবিদ্যাই হইল। তাই সম্প্রতি দেখা যাইতেছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও সর্বভারতীয় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বিবেকানন্দের নামে মহাবিদ্যার ছটায় চার দিক ভাসাইয়া দিতেছেন। মহাসমারোহে ঘোষণা করিতেছেন যে, স্বামীজি যাহা বলিতেন, তাঁহারাও ‘ঠিক’ একই কথা বলিতেছেন, একই ভাবনা পোষণ করিতেছেন, একই পথে হিন্দু ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব রচনায় ব্রতী হইতেছেন। অবশ্য, স্বীকার করিতেই হইবে, বিস্ময়ের অবকাশ নাই— এই ধূর্ত প্রয়াস বিজেপি প্রথম বার দেখাইতেছে না। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হইয়াই ইতিহাস দর্শন নৈতিকতা সমস্ত জলাঞ্জলি দিয়া বাবাসাহেব অম্বেডকরকে হিন্দুত্বের প্রবল প্রবক্তা হিসাবে তুলিয়া ধরিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দকে আপন স্বার্থে ব্যবহারের প্রতি সংঘ পরিবারের ঝোঁক, বস্তুত, নূতন নহে। তবে মোদী জমানায় তাহাতে এক নূতন মাত্রা যুক্ত হইয়াছে। সর্বগ্রাসী আত্মসাৎ-বাদ মোদী রাজনীতির এক বিশিষ্ট অভিজ্ঞান। আপাতত গোটা বিশ্বে ধর্মসমন্বয়-খ্যাত স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ ঐতিহ্যটি গ্রাস করিবার মধ্যেও সেই একই মানসিকতার প্রকাশ।

কুনাট্য আরও জমিয়া উঠিল যখন প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত লইলেন, বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার ১২৫তম বার্ষিকী ও দীনদয়াল উপাধ্যায়ের শতবার্ষিকী পালিত হইবে একই সঙ্গে। দুই জনকে একই মঞ্চে আরাধ্য হিসাবে দেখাইবার অন্তর্নিহিত বার্তাটি স্পষ্ট: দুই জনের বক্তব্যের মধ্যে সংযোগ ছিল, এমন একটি ধারণা জনমানসে প্রবিষ্ট করানো। অথচ স্বামীজির হিন্দু ধর্ম শ্রীযুক্ত উপাধ্যায়ের ধ্যানধারণা হইতে কেবল পৃথক নহে, স্পষ্টত এবং মূলত— বিরুদ্ধ। স্বামীজির ধর্ম বলে সর্বসংহতির কথা, ‘জীবে প্রেম’ অর্থাৎ সাম্য, সহিষ্ণুতা ও ঐক্যের কথা, এমনকী ঘোষণা করে যে ‘কখনও যদি কোনও ধর্মের লোক দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে এই সাম্যের কাছাকাছি আসিয়া থাকে, তবে একমাত্র ইসলাম ধর্মের লোকেরাই আসিয়াছে।’ (পত্রাবলী) হিন্দু ধর্ম কেন তাহা পারে নাই, স্বামীজি স্পষ্টাক্ষরে সেই যুক্তি দিয়াছেন, ‘প্রাচীন বা আধুনিক তার্কিকগণ মিথ্যা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া যতই ইহা ঢাকিবার চেষ্টা করুন না কেন, অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না।’

ফলত, নরেন্দ্র মোদী ও নরেন্দ্রনাথ দত্তের মিল দেখাইয়া অমিত শাহ বাজিমাত করিতে চাহিলে তাহা উচ্চমার্গের মিথ্যাচারণ ছাড়া কিছু নয়। পশ্চিমবঙ্গে আসিয়া এই ছলকৌশলটি তিনি বহুল পরিমাণে ব্যবহার করিলেন, হয়তো এই রাজ্য এখন তাঁহার অশ্বমেধ রাজনীতির প্রথম সারিতে বলিয়া। মুশকিল ইহাই যে, এই রাজ্যের কোণে কোণে স্বামীজির ভক্তসমাজ ছড়াইয়া আছেন, যাঁহারা জানেন, স্বামীজির মত ও পথ ঠিক কেমন ছিল। জানেন, তিনি কোনও ‘ম্লেচ্ছবাদ’ তিনি মানিতেন না, অন্ধ গোভক্তি লইয়া পরিহাস করিতেন, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জিহাদ চালাইয়াছিলেন, নারী স্বাধীনতার প্রবল সমর্থক ছিলেন। তাঁহার মতামত বর্তমান ভারতের আরাধ্য, সন্দেহ নাই, কিন্তু সেই ভারত নরেন্দ্র মোদীর সৌজন্যে ক্রমেই বহু আলোকবর্ষ দূরে সরিতেছে, সত্য ইহাই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE