বোঝা: নিজের চেয়েও ভারি বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রোজ স্কুলে যেতে যেতে ব্যথায় ভরছে শৈশব-কৈশোর। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
কিছু পুরাতন বইয়ের দোকান ওজনদরে বই বিক্রয় করিয়া থাকে। পরীক্ষার নোটবই হউক অথবা কালজয়ী সাহিত্য, দাঁড়িপাল্লা ও বাটখারা বইয়ের মূল্য বলিয়া দেয়। আজকাল শিক্ষার মানও কি এই ভাবেই নির্ধারিত হইতেছে? সন্দেহ হয়, হয়তো পড়ুয়াদের ব্যাগের ওজন দিয়া স্কুলের ওজন নির্ণয় হয়। সুনাম ও বেতন যে প্রতিষ্ঠানের যত অধিক, তাহার পড়ুয়াদের ব্যাগ ততই ভারী। শহরের একটি বিখ্যাত বিদ্যালয়ে দেখা গিয়াছে, প্রাথমিকের শিশুও নয় কিলোগ্রামের ব্যাগ বহন করিতেছে। একটি ব্যাগে সকল বই-খাতা আঁটে নাই বলিয়া বহিতেছে আরও একটি ব্যাগ। এই চিত্র সর্বত্র। প্রতিটি পাঠ্যবিষয়ের একাধিক বই, একাধিক খাতা, আঁকিবার খাতা, ডায়েরি, টিফিন বাক্স, জলের বোতল সব মিলাইয়া ব্যাগ ক্রমশই গুরুভার হইতে থাকে। শিশুদের কাঁধে-পিঠে, মেরুদণ্ডে সমস্যা দেখা দিবে, ইহাই স্বাভাবিক। সমস্যা নূতন নহে, প্রতিকারের অনুসন্ধানও নূতন নহে। দেশটি যে হেতু ভারত, তাই সমাধানের অনুসন্ধান অচিরে পৌঁছাইয়াছে আদালতে। এই মুহূর্তে সিবিএসই-র পাঠ্যবইয়ের ওজন কমাইবার আবেদন করিয়া একটি জনস্বার্থ মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনিতেছে। একাধিক হাই কোর্ট ব্যাগের ওজন কমাইবার নির্দেশ দিয়াছে। এ রাজ্যে স্কুলশিক্ষা দফতর শ্রেণি অনুসারে ব্যাগের ওজন বাঁধিয়া দিয়াছে। ফল হয় নাই। সংবাদে প্রকাশ, সরকারি স্কুলগুলিও সেই নির্দেশ মানে না।
কিন্তু এত নির্দেশের প্রয়োজনই বা কি? বাবা-মা শিশুর স্বার্থে কাজ করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। বেতন বাড়িলে তাঁহারা রাস্তা অবরোধ করিতে দ্বিধা করেন না। স্কুলব্যাগের ওজনে বাড়াবাড়ি হইলে তাঁহারাই নিশ্চুপ কেন? কারণ অভিভাবকদেরও ইহাতে সম্মতি আছে। পড়ার চাপে ন্যুব্জ, মুখ তুলিয়া তাকাইবার সময় বা ইচ্ছা নাই, এমন সন্তানই অধিকাংশের প্রার্থিত। ‘পড়াশোনার চাপ’ কোন স্কুলে কত, তাহা লইয়া অভিভাবকরা আস্ফালন করেন। স্কুলগুলিও এক একটি বিষয়ে চার-পাঁচটি করিয়া পাঠ্যবই দিয়া বুঝাইয়া দেয়, শিক্ষার মান কত উৎকৃষ্ট। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুও তিন-চার ঘণ্টা স্কুলে কাটাইয়া, ফের কোনও শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে পড়িতে বসে। অর্থাৎ পঠনপাঠনকে কষ্টসাধ্য করিতে চায় স্কুল ও পরিবার। ব্যাগের ওজন তাহার ইঙ্গিতমাত্র। শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিলেও স্কুলব্যাগ হালকা হইবে কি? শিক্ষাকে নির্ভার, আনন্দময় করিতে কেহ চাহে না। শিশু যদি ভয় না পাইল, তর্জন-গর্জন শুনিয়া কাঁদিয়া না ভাসাইল, তবে শিক্ষার হইল কী?
শিশুর স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য যথাসম্ভব চাপিয়া-চুপিয়া ‘ভাল ছাত্র’ নামক মোড়কটিতে ঢুকাইয়া দিতে পারিলে সকলেই নিশ্চিন্ত। রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন— শিক্ষাকে আমরা বহন করিলাম, বাহন করিতে পারিলাম না। আজ তাহা আরওই সত্য। জ্ঞান হইতে কল্পনা, কল্পনা হইতে আরও কৌতূহল ও আরও অনুসন্ধান, এই পথে শিশুর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন চিন্তার শক্তি বিকশিত হয়। কিন্তু সমাজের চক্ষে তাহা ঝুঁকিপূর্ণ। ‘যেটুকু শিখাইব, সেটুকুই শিখিবে’, এই নিয়ন্ত্রণে নিশ্চয়তা খুঁজিতে সকলে অভ্যস্ত। তাই অকারণ পড়ার ভারে শিশুর স্বাভাবিক মননশক্তিকে চাপিয়া রাখিতে এত আগ্রহ। গুরুভার স্কুলব্যাগ অনর্থক নহে। তাহা সমাজ-সংসারের বৃহত্তর প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy