Advertisement
E-Paper

জ্বরাসুর মাহাত্ম্য

চার দিকে যে ভাবে অজানা জ্বর, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে, তাতে ফের জ্বরাসুরের পুজো করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা তো তুচ্ছ মানুষ! লব, কুশকে বাঁচাতে জ্বরাসুরের পুজো করতে হয়েছিল স্বয়ং সীতাকেও।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

চার দিকে যে ভাবে অজানা জ্বর, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে, তাতে ফের জ্বরাসুরের পুজো করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমরা তো তুচ্ছ মানুষ! লব, কুশকে বাঁচাতে জ্বরাসুরের পুজো করতে হয়েছিল স্বয়ং সীতাকেও।

জ্বরাসুর আসলে বসন্ত রোগের দেবী মা শীতলার পুরোধা সৈনিক। শীতলা এক দিন তাঁর সৈন্যসামন্তদের ডেকে বললেন, ‘‘চলো, মুনিদের আশ্রমে যাই। লব, কুশকে জ্বরে ভোগাতে হবে। তা হলেই মর্তে আমার মাহাত্ম্য প্রচারিত হবে।’’ শীতলার সঙ্গী জ্বরাসুর, চামুণ্ডাল (ত্বকে চুলকানি ও প্রদাহ এঁর অবদান), বিষ-বসন্ত সবাই প্রথমে বলল, ‘‘জানকী এমনিতেই অনেক দুঃখ বোধ করেছেন। আবার লব, কুশকে অসুস্থ করে দেবেন?’’ শীতলা ছাড়লেন না। তিনি এক থুত্থুড়ে বুড়ির ছদ্মবেশে বাল্মীকির আশ্রমে চললেন। তাঁর হাতে এক রঙিন ঝুড়ি, সেখানে চাপা দেওয়া হাম ও বসন্তের গুটি।

লব, কুশ তপোবনে খেলতে খেলতে ছুটে এল, ‘‘এই বুড়ি, তোমার ঝুড়িতে কী আছে?’’ বুড়ি উত্তর দিল, ‘‘এমন কিছু নয়, ডালের দানা।’’ তপোবনের শিশুরা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘‘মিষ্টি খেতে তো? তা হলে আমাদের দাও।’’ বুড়ি বলল, ‘‘এমনি এমনি কিছু নেওয়া যায় না গো ছেলেরা।’’ লব, কুশ দুই ভাই তখন ঝুড়ি ধরে টানাটানি আরম্ভ করল, ‘‘আমাদের দিতেই হবে। জানো, আমরা কে?’’ বুড়ি উত্তর দিল, ‘‘দুর, রামচন্দ্রের ছেলে দুটো মহা অসভ্য তো! মরবি, মরবি।’’ লব, কুশেরা সেই ডালের দানা খেতে শুরু করল। বুড়ি অন্তর্হিত হল। জ্বরাসুরকে নির্দেশ দিল, ‘‘যাও, এ বার ওদের আক্রমণ করো। লব, কুশের গলা ভাল ভাবে চেপে ধরো, যাতে কথা বলার সামর্থ্যও না থাকে।’’

অসুস্থ শিশুদের নিয়ে তপোবনের মহিলারা কাঁদছেন। সীতা মাঝে মাঝে মূর্ছিত হয়ে পড়ছেন, ফের আক্ষেপ করছেন, ‘‘এর চেয়ে লঙ্কায় রাক্ষসীরা আমাকে মেরে ফেলল না কেন? সেও ভাল ছিল।’’ নারদ এলেন, হনুমানকে ডাকা হল। হনুমান দেবচিকিৎসক ধন্বন্তরীকে পিঠে করে উড়িয়ে নিয়ে এলেন। ধন্বন্তরী সীতা ও অন্যদের বললেন, ‘‘আপনারা শীতলার পুজো করুন। বলুন, তুমি ভয়বিনাশিনী ভদ্রকালী, তুমিই শিবের অর্ধাঙ্গিনী মহেশ্বরী, তুমি শুভদায়িনী মঙ্গলা, তুমিই জয়দাত্রী জয়ন্তী। মা, তুমিই পতিতপাবনী, তুমিই আদ্যাশক্তি।’’ মন্ত্রপাঠ করে আক্রান্ত শিশুদের নিমের জলে স্নান করালেন ধন্বন্তরী। লব, কুশ ও অন্যরা সেরে উঠল। মর্তধামে শীতলা, জ্বরাসুরের পুজো প্রচারিত হল।

গল্পটা আছে অষ্টাদশ শতকে মানিকরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘শীতলামঙ্গল’ কাব্যে। মানিকরামের ‘ধর্মমঙ্গল’ বিখ্যাত, কিন্তু শীতলা, জ্বরাসুরদের নিয়েও তিনি মঙ্গলকাব্য লিখেছিলেন। বাঙালি আজকাল আধুনিক ও ‘সেকুলার’ হয়েছে। অস্ত্র হাতে রামনবমী করা উচিত কি না, হনুমানপুজো আরও বেশি করা উচিত কি না, এ সব নিয়ে তর্ক করে। কিন্তু খেয়াল রাখে না, তার মঙ্গলকাব্যে যে রামচন্দ্রের সন্তানরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক দিকে সর্বভারতীয় রাম-সীতা-লব-কুশ, অন্য দিকে সেই ভারতীয়ত্বে নিজের চেনা রোগের অভিজ্ঞতা বুনে দেওয়া, এখানেই বাঙালির নিজস্বতা।

রোগ-ব্যাখ্যানের এই নিজস্বতা তৈরি হয়েছে বহুত্বের আদানপ্রদানে। পৃথিবীতে জ্বর কী ভাবে এল, তা নিয়ে চরকসংহিতায় দক্ষযজ্ঞের কাহিনি আছে। দক্ষ তাঁর যজ্ঞে শিবকে আহুতি দেননি, শিব রেগে তৃতীয় নয়নে ক্রোধাগ্নি ঝরালেন। সেই আগুন থেকে ভূত-প্রেত বেরিয়ে দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করল। শেষে তারা শিবকে জিজ্ঞেস করল, ‘‘এ বার কী করব?’’ শিব বললেন, ‘‘কিছু করতে হবে না। মানুষের শরীরে জন্ম, মৃত্যু আর তার মাঝে কোনও কোনও সময় উত্তাপ ছড়িয়ে জ্বর রূপে থাকবে তোমরা।’’ চরকের আমলে দেবীমাহাত্ম্য সে ভাবে প্রচারিত হয়নি। তাই দক্ষকন্যা সতীর অপমান ও দেহত্যাগের কথা নেই। পরে দেবীমাহাত্ম্য জনপ্রিয় হল, জ্বরের সঙ্গী শীতলাকে ‘তুমিই জয়ন্তী, তুমিই আদ্যাশক্তি’ বলে বাংলার কবি প্রণাম করতে শেখালেন।

শিব এবং মহামায়াই সব নন। জ্বরজ্বারি নিয়ে বাংলার কবিরাজি মহলে আরও একটি গল্প ছিল। দৈত্য বাণরাজার মেয়ে উষার প্রেমে পড়েছে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। রাজকন্যার শয়নগৃহে সেই তরুণকে বন্দি করল বাণের সেনারা। শ্রীকৃষ্ণ কী আর করবেন? যুদ্ধ ব্যতিরেকে উপায় নেই। প্রবল যুদ্ধ, শিব এগিয়ে এলেন তাঁর ভক্ত বাণের সম্মান রক্ষায়। ছেড়ে দিলেন রুদ্র-জ্বর। সৈন্যসামন্ত থেকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও আক্রান্ত হলেন সেই রোগে। তখন কৃষ্ণ নিজের শরীর থেকে সৃষ্টি করলেন বিষ্ণু-জ্বর। অতঃপর দুই জ্বরে ভয়াল সংগ্রাম, রুদ্র-জ্বর পরাস্ত হল। বিষ্ণু-জ্বর ফিরে এল শ্রীকৃষ্ণের শরীরী তূণে। রুদ্র-জ্বরকেও ক্ষমা করে দিলেন কৃষ্ণ, ‘‘তুমি এ বার শুধু জ্বর হিসেবে ঘুরে বেড়াও।’’ ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ প্রজিতবিহারী মুখোপাধ্যায় সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে জানিয়েছেন, জ্বরের উৎস হিসাবে কবিরাজিতে দু’টি গল্পই পাশাপাশি চলত। একটির বয়ান কখনও অন্যটিকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেনি।

কিন্তু জ্বরাসুর কি শুধুই শীতলার অনুগত সেনাধ্যক্ষ? জ্বরাসুরের আলাদা মূর্তি ছিল। হরিবংশ ও বিভিন্ন গ্রন্থ জানাচ্ছে, জ্বর-দেবতার তিন পা, তিন মাথা, ছয় বাহু ও নয়টি চোখ। কেশ স্বর্ণাভ, নখস্পর্শ বজ্রাধিক। পুজোর আলাদা মন্ত্র ছিল, ‘কৃশপিঙ্গললোমক্ষং কৃষ্ণাঞ্জনচয়োপমম্/প্রলয়াম্বুদনির্ঘোষং সর্বভূতভয়াপহম্।’ এখন যেমন পেট খারাপ হলে অর্থোপেডিক দেখবেন না, জ্বরজ্বারি নিয়ে গেলে হৃদ্‌রোগবিশেষজ্ঞ ভাগিয়ে দেবেন, দেবতারাও অনেকটা সে রকম। জ্বর হলে জ্বরাসুর, বসন্ত হলে শীতলা, কলেরা হলে ওলাবিবি আর খোস-পাঁচড়া হলে পাঁচু ঠাকুরের থানে যেতে হবে। নামেই মালুম, ওলাবিবি মুসলমান। তাঁর আর এক নাম ওলাইচণ্ডী, তিনি মা শীতলার বোন। অসুস্থতার এই দেবীদের আইডেন্টিটি এতটাই নমনীয় যে হিন্দু ওলাইচণ্ডী ও মুসলমান ওলাবিবিতে ফারাক নেই।

এই দেবদেবীদের দেখলেই ঠাহর হয়, লোকজীবনে হিন্দু-মুসলমান কখনও আলাদা ছিল না। কেউ ইদ মানে, কেউ বা দুর্গা পুজো করে, কিন্তু অসুস্থ হলে সবাই একই থানে সিন্নি চড়ায়।

পরে, ব্রিটিশ আমলে গল্পটা অন্য রকম হয়ে গেল। কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি এবং হোমিয়োপ্যাথি তিনটি হয়ে গেল রুদ্ধদ্বার কক্ষ, একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ থাকল না। উনিশ শতকেও কবিরাজ সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর আয়ুর্বেদ ও ম্যালেরিয়া জ্বর বইয়ে আয়ুর্বেদ ও অ্যালোপ্যাথির যোগসাজশের চেষ্টা করছেন। জানাচ্ছেন, ভূত মানে তালগাছের মতো লম্বা, ঘূর্ণায়মান চোখ আর নাকি সুরে কথা বলা বিদেহী আত্মা নয়। বিভিন্ন পরজীবী উদ্ভিদাণু ও জীবাণুই রুদ্রসৃষ্ট ভূত। তখনও দুই ভিন্ন ঘরানায় কথোপকথনের চেষ্টা চলছে, ক্রমে সব বন্ধ হয়ে গেল।

দরজা বন্ধের কারণ, সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায় এমন একক তত্ত্ব হাজির করতে হবে। অ্যালোপ্যাথির তত্ত্বে থাকবে জীবাণু ধ্বংস, হোমিয়োপ্যাথিতে রোগীর ধাত, কবিরাজিতে বায়ু-পিত্ত-কফ— তিনের ভারসাম্য বজায় না থাকা। কবিরাজিতে যে আরও অনেক রকমের তত্ত্ব ছিল, সে কথা হারিয়ে গেল। অনেক রকমের তত্ত্ব থাকলে সে নিশ্চয় অবৈজ্ঞানিক! এমন একটা তত্ত্ব, যার খোপে সব কিছু ঢুকিয়ে অক্লেশে ব্যাখ্যা করা যাবে, তাকেই তো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বলে!

চিকিৎসার এই রুদ্ধদ্বার আর যা-ই হোক, ভারতীয় সংস্কৃতি নয়। হিন্দু শীতলার সঙ্গে তাই প্লেগের বৌদ্ধ দেবী পর্ণশর্বরীর আকৃতিগত অনেক মিল, জ্বরের বৌদ্ধ দেবতা হয়গ্রীব ও হিন্দু জ্বরাসুর প্রায় এক।

এই বহুমুখী আদানপ্রদান আমরা ভুলে গিয়েছি। সিন্ডিকেটের দাপটে এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। সিন্ডিকেট শুধু ইট, বালি সরবরাহ করে না। কোনও গোষ্ঠী যদি নিজের লাভের জন্য অন্য সবাইকে দমিয়ে নিজেদের কথাই প্রচার করতে থাকে, তাকেই সিন্ডিকেট বলে।

হিন্দুত্বের সিন্ডিকেটে মা জানকী তাই অযোধ্যাতেই আটকা পড়ে আছেন, শীতলা ও জ্বরাসুরের মাহাত্ম্য প্রচার করে রোগ থেকে আর আমাদের বাঁচাবেন না, এটাই যা দুঃখের!

Doctor Malaria
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy