Advertisement
১১ মে ২০২৪

শালবনিতে দরিদ্রদের জমি দিতে আহ্বান বিনোবা ভাবের

মেদিনীপুর জেলায় দু’বার এসেছিলেন। হেঁটে ঘুরেছিলেন গ্রামে গ্রামে। সংগ্রহ করেছিলেন দরিদ্র এবং ভূমিহীনদের জন্য জমি। মেদিনীপুরে বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলন নিয়ে লিখলেন বিমলকুমার শীটদরিদ্র এবং ভূমিহীনদের জমির সংস্থান করতে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটেছিলেন বিনোবা ভাবে।

রসুলপুর গ্রামে বিনোবা ভাবের আগমনের স্মৃতিমঞ্চ।  নিজস্ব চিত্র

রসুলপুর গ্রামে বিনোবা ভাবের আগমনের স্মৃতিমঞ্চ। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সভা চলছিল শালবনিতে। দেখা করতে এলেন এক চালকলের মালিক। সভার পুরোধা তাঁকে বললেন, ‘এক ষষ্ঠাংশ দান করুন’। উত্তরে মালিক বললেন, ‘এ বিষয়ে অন্য সব মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব’। কিন্তু তাতে প্রভাবিত হননি সেই পুরোধা। তিনি জানালেন, ‘তা তো নেবেন। কিন্তু যমরাজের ডাক তো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এক একজন মালিকের কাছেই আসবে। তিনি তো সমস্ত মালিকদের একসঙ্গে ডাকবেন না। সুতরাং আপনার সিদ্ধান্ত আপনি নিজেই নিন এবং প্রতি বছর সম্পত্তি দানযজ্ঞে এক ষষ্ঠাংশ করে দিতে থাকুন’। চালকলের মালিক তাঁর কথা মেনে নিয়েছিলেন। করেছিলেন ভূদান।

এই পুরোধা ব্যক্তি বিনোবা ভাবে। যিনি দরিদ্র এবং ভূমিহীনদের জমির সংস্থান করতে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটেছিলেন। ভূদান আন্দোলনে জমি সংগ্রহ করতে এসেছিলেন মেদিনীপুরেও।

দেশ তখন বছর চারেক স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ ভূমিহীন। দেশের শতকরা ৭৬ জনেরও বেশি কৃষি বা সেই সংক্রান্ত শিল্পব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূমির মালিকানা তাঁদেরই হাতে যাঁরা স্বয়ং বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরাসরি চাষাবাদ করেন না। চাষবাসের আসল কাজ করেন ভূমিহীন কৃষক। কোথাও তাঁরা এর বিনিময়ে মজুরি পান। এবং কোথাও ভূমিদাস হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন। এর মাঝে ছিল আরও নানা মধ্য ও উপ স্বত্ব। এই প্রথা ভাঙতে চাইলেন বিনোবা ভাবে। দরিদ্র এবং ভূমিহীনদের জন্য জমি সংগ্রহে নামলেন তিনি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল। তেলঙ্গানার নালগোন্ডা জেলার পোচমপল্লি গ্রামে। উপস্থিত গ্রামবাসীদের কাছে ভূমিদানের আবেদন জানালে রামচন্দ্র রেড্ডি বিনা শর্তে ১০০ একর জমি দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। নিজাম থেকে ধনী চাষি, বহুজন জমি দিয়েছিলেন। কোনও একজন ভূস্বামী দিয়েছেন দশ হাজার একর জমি। তেলঙ্গানার এক কৃষকের ছিল এক একর জমি। তিনিও দিলেন এক গান্থা (মোট জমির আট ভাগের এক ভাগ)। শুধু তেলেঙ্গানা থেকে সংগৃহীত হল ৩৫০০০ হাজার একর জমি।

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অন্যতম শিষ্য। সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ছিল তাঁর জীবনাচারণ। বিনোবা ভাবের ডাকে সাড়া দিলেন বহু মানুষ। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি তিনি সঙ্গীদের নিয়ে বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার শালতোড়ায় এলেন। তারপর পাবড়া, মেজিয়া, বন আশুড়িয়া, অমর কানন, বিহারজুড়িয়া, বাঁকুড়া শহর, ওন্দা, বিষ্ণুপুর, বাঁকাদহ, হয়ে মেদিনীপুরের গড়বেতা আসেন ১২ জানুয়ারি। সঙ্গী হন সুতাহাটার গাঁধীবাদী কুমারচন্দ্র জানা। গড়বেতার পর চন্দ্রকোনা-রোড, শালবনি, গোদাপিয়াশাল, মেদিনীপুর শহর, খড়্গপুর শহর, বলরামপুর, ভেটিয়া, খাজরা, কুকাই, রসুলপুর নেকুড়সেনি ও দাঁতনে যান ২৫ জানুয়ারি। প্রায় দিন পনেরো বিনোবা ভাবে মেদিনীপুর জেলায় ভূদান যজ্ঞ আন্দোলন করে ছিলেন। ১০-১২ কিমি পথ হাঁটার পরে কোনও জায়গায় রাত্রিবাস করতেন। এবং সেখানকার সভায় ভূদান নিয়ে বক্তব্য রাখতেন। এই সময় প্রতিটি সভায় তাঁর ভাষণ লিপিবদ্ধ করেছেন সঙ্গী পরমেশ বসু। তখন বাংলার কংগ্রেস কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ছ’মাসে কংগ্রেস কর্মীরা ঘরে ঘরে ভূদানের সংবাদ পৌঁছে দেবেন। এই সময়েই শালবনির চাল মালিকের সঙ্গে কথোপকথন। তিনি ওই চালকল মালিককে বলেছিলেন, দরিদ্রদের ভূমির প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাতে স্বাধীনতার স্বাদ বাড়বে, দেশের প্রতি প্রেম বাড়বে। দারিদ্র যদি স্বাধীনতা লাভের পরও থেকে যায়, তাহলে গরিবেরা বলবেন, এ স্বাধীনতায় তাঁদের কী লাভ? তাই গরিবদের সেবায় জমির এক ষষ্ঠাংশ অবশ্য দেওয়া চাই।

১৬ জানুয়ারি বিনোবা ভাবে মেদিনীপুর শহরে এক সভায় বলেন, ‘ভূদানের কাজকে কেবল ভূমি সমস্যা সমাধানের কাজ হিসাবে দেখলে ভুল হবে, এ জনসাধারণের শক্তি বড়াবার কাজ। এতে জনসমাজ স্বাধীন হবে, সমাজের বিকাশ হবে। এই স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিচার যদি মনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবে দলগুলির কাজ আপনাদের কাছে ফিকে লাগবে’। সেই সঙ্গে তিনি অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য শহরের যুবকদের এগিয়ে আসতে বলেন। হরিজনদের আলাদা স্কুল চলার কথা শুনে মর্মাহত হন।

২৩ জানুয়ারি বিনোবা ভাবে কুকাইয়ের পর বেলদা পার হয়ে রসুলপুর গ্রামে যান। এর প্রধান উদ্যেগী ছিলেন তৎকালীন বিধায়ক সুরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। বিনোবা রসুলপুর মাঠে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন ‘ভূদানের মাধ্যমে গাঁয়ের সমস্ত জমি গাঁয়ের আর দেশের সমস্ত ধন-সম্পত্তি দেশের হয়ে যাক –আমরা এই চাই। এখন ছয় ভাগের এক ভাগ চাওয়া হচ্ছে। এ প্রথম পাঠ আর এতে ভূমিহীনেরা কিছু না কিছু জমিও পেয়ে যাবেন’। তাঁর বক্তব্যের পর অনেকে জমিদান করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন গোপালচন্দ্র মাইতি, মহেশ্বর নায়েক, উপেন্দ্রনাথ বর, সুরেশচন্দ্র বর, জ্যোতিন্দ্রনাথ পয়ড়া, হরপ্রসাদ গিরি, বৈদ্যনাথ পতি, রাজেন্দ্রনাথ প্রামাণিক, সুরেন্দ্রনাথ প্রামাণিক, হাড়োচরণ ঘোড়াই প্রমুখ। সেই সময় শ্যামসুন্দরপুর গ্রামটিও দান করা হয়। এখান থেকে ওড়িশা যাওয়ার পথে নেকুড়সেনিতে সভা করেন তিনি। সাঁজ্ঞাপাড়ার ও কুটকি গ্রামের কেউ কেউ জমিদান করেন। আর ডহরপুর গ্রামের অর্ধেক দান করা হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে তিনি মোট তিনবার (১৯৫৫, ১৯৬১ এবং ১৯৬৩ সালে) পদযাত্রা করেন। যাত্রার ফল, এই রাজ্যে ৮২১০ জন মোট ১২৩৫৪,৬৯ একর জমি দান করেছেন। এর ফলে প্রায় পনেরো হাজার ভূমিহীন কৃষক অনাহার থেকে বাঁচেন। কাজের সন্ধান পান। ৭৫০টি গ্রামদানও করা হয়েছিল। মেদিনীপুর জেলায় বিনোবা ভাবে দু’বার (প্রথমবার ১৯৫৫ ও দ্বিতীয়বার ১৯৬৩ সালে) এসেছিলেন। দ্বিতীয়বার কাঁথি হয়ে আসেন। সেবার জেলায় নেতৃত্ব দেন বিমলচন্দ্র পাল। রসুলপুর মাঠে সভা করেছিলেন। রাত্রিযাপন করেছিলেন দেউলি বেসিক ট্রেনিং কলেজে। কিন্তু ভূদান আন্দোলনের সমালোচনাও করা হয়েছিল সেই সময়ে। জমিদাতারা যে জমিদান করেছিলেন তা আইনগত ভাবে কায়েম হয়নি। উত্তরপুরুষেরা পূর্বসূরিদের দান অস্বীকার করেন। সরকারও হস্তক্ষেপ করেছিল। মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।

রসুলপুরের বাসিন্দারা বিনোবা ভাবেকে আজও মনে রেখেছেন। গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘প্রতি বছর ৯ মাঘ রসুলপুর গ্রামের মাঠে বিনোবা ভাবের স্মরণে মেলা বসে। লোকমুখে তা বিনোবাজি মেলা নামে পরিচিত। আগে খাওয়ানো হত। এখন বন্ধ। প্রথমে প্রভাতফেরি হয়। তারপর এই মাঠে বিনোবা ভাবে যে বক্তৃতা করেছিলেন তার কিছু অংশ পাঠ করা হয়।’’ প্রথম এবং দ্বিতীয়বার বিনোবা ভাবের পদযাত্রায় যুক্ত ছিলেন বেলদার বিমলচন্দ্র পাল। তিনি মেলায় প্রতি বছর আসেন। আধুনিক প্রজন্ম ভুলে গেলেও রবীন্দ্রনাথ প্রামাণিক, কৃত্তিবাস মণ্ডল, পারিজাত কুসুম দাসেরা বিনোবা ভাবের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। দরিদ্রদের জমি দানের প্রচেষ্টাকেও।

লেখক শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Vinoba Bhave Human Rights activist Land Reform
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE