Advertisement
E-Paper

পরিকল্পিত ভাবে ছড়াল সংঘর্ষ

প্রত্যেক শহরের মতো আসানসোলেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই শহরে কেবল হিন্দু-মুসলমান নয়, খ্রিস্টান জনসংখ্যাও যথেষ্ট। বৃহত্তর শহরাঞ্চলে আছেন যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধ। কেবল ধর্মগত তফাত নয়।

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০০

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাইরে থেকে যত মানুষ আসানসোলের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন, এক জন আসানসোলবাসী হিসাবে তাঁদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেল যে এক জায়গায় বিপদ হলে এখনও নানা জায়গা থেকে দ্রুত সাড়া পাওয়া যায়। কম কথা নয়। বিশেষত যখন আমরা প্রায়ই বলি বিচ্ছিন্নতার কথা, প্রতিবেশীর উদাসীনতার কথা।

তবু, সভয়ে করজোড়ে একটি কথা নিবেদন করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সেটা এই যে, আসানসোলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। ১৯৮৯ সালের ভাগলপুর, লালকৃষ্ণ আডবাণীর রামরথ চালনাকালীন কলকাতা, দু’টি জায়গাকেই কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য আমার ঘটেছিল। সেই জন্যই এ কথা বলতে পারছি যে আসানসোলে রামনবমী-হনুমান জয়ন্তী উপলক্ষে কোনও দাঙ্গা হয়নি। হতে পারত। অন্য অনেক জায়গার মতোই এখানেও অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালি মনে মনে সংখ্যালঘু-বিরোধী। এই বিরোধিতা হয়তো কুসংস্কারের মতোই, কোনও বাস্তব কারণ বা যুক্তির ধার ধারে না। একটি রাজনৈতিক দল ঠিক হিটলারের আদলেই এদের মাথার মধ্যে মন্ত্র পড়ে, ওই ‘অপর’রাই তোমার সব দুর্দশার মূল কারণ। আমরা এক বার গদিতে বসতে পেলেই তোমাদের সকলের জন্য এসে যাবে আরাম, বিলাস, সম্পূর্ণ সৌভাগ্য। এই কথায় বিশ্বাস করে বা না-করেও অপরকে ঘৃণা করা সুবিধাভোগী লোকের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এঁদের ঘৃণাও হিসাব কষা, এঁরা নির্বিচারে খুন করতে দৌড়োবেন না। বিশেষত যদি পুলিশের ভয় থাকে। নিজেদের ঘরে বসে গজগজ করবেন, এইটুকুই।

প্রত্যেক শহরের মতো আসানসোলেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই শহরে কেবল হিন্দু-মুসলমান নয়, খ্রিস্টান জনসংখ্যাও যথেষ্ট। বৃহত্তর শহরাঞ্চলে আছেন যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধ। কেবল ধর্মগত তফাত নয়। ভাষাগত, রাজ্যগত, সংস্কৃতিগত বিভিন্নতাও আছে। বাঙালি, বিহারি, মারোয়াড়ি, পঞ্জাবি— এক সময়ের এখানকার চালু ঠাট্টা ছিল, পঞ্জাবের সবচেয়ে বড় শিল্পনগরীর নাম বার্নপুর।

এক দিকে রেল, লোহা কারখানা, কয়লা, অর্থাৎ দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজি, অন্য দিকে গোটা দেশ থেকে জড়ো হওয়া অসংখ্য শ্রমিক ও অফিসকর্মী। তা ছাড়া ধানবাদ-টাটা-কলকাতার মধ্যবর্তী এই আসানসোল-রানিগঞ্জ যথেষ্ট বৃহৎ এক বাজারও বটে। এবং এই মিশ্রিত জনসমষ্টি এখানে বাস করছেন একশো বছরের বেশি সময় ধরে।

দীর্ঘ কাল একত্র বসবাসের ফল হিসাবে ইচ্ছা-অনিচ্ছা-নিরপেক্ষ ভাবেই এক রকম স্থিতাবস্থা তৈরি হয়। বিশেষত যেখানে বিশাল অঙ্কের টাকা নিশ্চিন্ত ভাবে আবর্তিত হয়ে থাকে। এই ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির লোকদের মধ্যে নানান কারণে ক্রমশ নানাবিধ আন্তঃসম্পর্কও তৈরি হয়। এ শহরে জীবনযাপন ধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার মতো হিংসা ছড়িয়ে না পড়ার কিছু বাস্তব কারণ থেকে যায়। ফলে অপেক্ষাকৃত নতুন ক্ষমতাধারী অথচ পৃষ্ঠবলে বলীয়ান কোনও রাজনৈতিক দলের যদি অত্যন্ত আগ্রহ হয় এই বাজারে নতুন কিছু পুঁজিমালিক আমদানি করে নিজেদের দলের ফান্ড ও পেশিশক্তি বর্ধন করার, তা ক্ষতিকারক হলেও, সে চেষ্টা নিবারণ করা কঠিন। স্মর্তব্য সেই আপ্তবাক্য, ‘‘...না শোনে’’ ইত্যাদি। সম্প্রতি আসানসোল ঠিক এই মুখোশ-পরা অর্থনৈতিক উচ্চাশার শিকার হয়েছিল বলে শহরের লেখক-সাংবাদিক-সহ অনেক বাসিন্দাই মনে করছেন। তাঁরা এটাও বলছেন যে এই উচ্চাশার দায় পুরোপুরি কোনও একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের, এমনটা বলা যায় না। সুলভ ধর্মের তাস খেলে অনেকেই লাভবান হওয়ার কথা ভেবেছিলেন। সেই কারণেই প্রথম দিনে যা ছিল প্রত্যক্ষ ভাবেই দুই রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব, দু’দিন পরে তা ঘুরে গেল সাম্প্রদায়িক চেহারায়। পরিকল্পিত ভাবে এক উজ্জ্বল তরুণের প্রাণ গেল। শহরের বিভিন্ন জায়গায়, বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও, দোকানে আগুন লাগানো, গাড়ি পোড়ানো হল। রানিগঞ্জে এক জন মারা গেলেন, প্রায় একশো পুরনো দোকান পুড়ে গেল। কিন্তু তবু বলা যাচ্ছে যে এগুলি ছিল প্রধানত উস্কানি। এ কথা বলবার কারণ এই যে অবিকল একই রকম ঘটনা আসানসোল আগেও দেখেছে। ১৯৯২ সালে রামরথ পরিক্রমার কালে শহরের এক বিশেষ অঞ্চলে কয়েকটি দোকান ধীরেসুস্থে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এক জন নিরীহ যুবক, যিনি বাজারে সামান্য দর্জির কাজ করতেন, তাঁকে পরিকল্পিত ভাবে খুন করে সেই এলাকায় ঢুকবার মুখে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। সে বারে এই কাজের সঙ্গে জড়িত বলে আরএসএস-এর সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা এক জনের নাম বার বার শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সে বারও দাঙ্গা বাধেনি আসানসোলে। দুই পক্ষের সুস্থবুদ্ধি নাগরিকেরা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন। দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রশাসনও।

এই বছরও একই ঘটনা দেখলাম আমরা। মানুষের প্রাণকে দাবার বোড়ের মতো ভাবে ব্যবহার করা। আমরা সকলেই অপার গৌরব অনুভব করি ইমাম রশিদির মতো এক জন মানুষের শহরে থাকি বলে। গৌরব অনুভব করি এ জন্যও যে, এ বারও নানা পাড়ায় গোলমাল লাগবার উপক্রম হলে প্রায় সর্বত্রই সবচেয়ে আগে, পুলিশ পৌঁছনোরও আগে, বাধা এসেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে। প্রবল কোনও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবই যে এই বাধার জনক, তা না-ও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই বাধাদানকারীরা বলেছেন, এখানে কোনও ঝামেলা করা চলবে না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে দিতে চান না। একে একটি সদর্থক মনোভঙ্গি বলা যায় বইকি। অন্যের নিরাপত্তা যে নিজের নিরাপত্তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত, এ কথা তো সমাজবিজ্ঞানের প্রথম সত্য।

আমাদের বহু মানুষ ভিন্নতাকে এখনও সুরক্ষা দেন, এমনকী নিজেদের স্বার্থে হলেও, এ কথা জানা নিশ্চয়ই স্বস্তির। তবু, কাঁটা রয়েই যায়। বহু মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়েরই, আজও, এত বছর গায়ে গায়ে বাস করার পরও, পরস্পরকে জানেন না, চেনেন না ব্যক্তিগত ভাবে। এই অপরিচয়ের দুর্বলতার ফাঁক দিয়েই বার বার ঢুকে পড়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সংশয়, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা। সকলেই জানি এই কথা। প্রতি বার এই সব ধুলোঝড়ের সময়ে, যখন একে অন্যের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই না, আমরা সকলেই ভাবি এই অপরিচয়কে পেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আবার যেই শান্ত হয়ে আসে দিনকাল, আমরা সকলেই নিজের নিজের বৃত্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, পরের বার আবহাওয়া থমথমে হয়ে ওঠা পর্যন্ত। এই খাতটা পার হতে হবে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায়। কিন্তু কেমন করে? আসুন, সম্প্রীতি করি— বলে তো সত্যিই কিছু হয় না।

অথচ প্রতিটি শহরের, প্রতি এলাকাতেই এমন বহু সমস্যা থাকে যা তার জীবনমরণের সঙ্গে যুক্ত। জল, রাস্তা, দূষণ, গাছ কমে যাওয়া, বে-লাগাম গাড়ির বিপদ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য পরিষেবা— এ রকম অনেক সমস্যা যা নগর প্রশাসনকে ধরিয়ে দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। নগরের বিভিন্ন পাড়ার বাসিন্দারা যদি এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য হাত মিলিয়ে উদ্যোগী হন? যদি নিজেরা চেষ্টা করেন পুরপরিষেবাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে? সেই সব কাজের মধ্য দিয়ে কি জেগে উঠবে না এক রকম প্রকৃত বন্ধুত্ব? জানবার, বুঝবার, সহযোগিতা করার বন্ধুত্ব?

Violence planned manner
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy