Advertisement
১৭ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ভোটারমুখী কূটনীতি

মানুষ-নিধনই যথেষ্ট গুরুতর কুকার্য। তাহার উপর যদি নিধনান্তে নিহতের শরীর হইতে মস্তক ছেদন করা হয়, তবে তো তাহা অতি গর্হিত কুকার্য।

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৭ ০১:২২
Share: Save:

মানুষ-নিধনই যথেষ্ট গুরুতর কুকার্য। তাহার উপর যদি নিধনান্তে নিহতের শরীর হইতে মস্তক ছেদন করা হয়, তবে তো তাহা অতি গর্হিত কুকার্য। সুতরাং ভারতীয় জওয়ানের যে দুর্দশা পাকিস্তানি সৈন্যরা করিয়াছে, তাহা প্রমাণিত হইলে ভারতীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানি রাষ্ট্রের উপর বিদ্বিষ্ট হইতেই পারে, কড়া পদক্ষেপও লইতে পারে। সীমান্তে প্রহরা বাড়াইতে পারে, শাসানি দিতে পারে। সবই যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু ভারতীয় সেনার মাথা কাটা হইয়াছে বলিয়া সাধারণ পাকিস্তানি নাগরিককে অপমানিত করা কিংবা হেনস্তা করার কোনও যুক্তি আছে কি? বিশেষত যখন সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের বয়স মাত্র এগারো হইতে পনেরো? লাহৌরের এক বিদ্যালয়ের পঞ্চাশ জন ছাত্র শিক্ষামূলক ভ্রমণে ভারত সফরে আসিয়াছিল, একটি বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসাবে। ভারতীয় পক্ষ তাহাদের যথাযোগ্য ভিসাও দিয়াছিল, সেই ভিসার জোরে ছাত্রদল সীমান্ত পার হইয়া অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখিয়া দিল্লি পৌঁছাইয়াছিল। হঠাৎই কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখায় সামরিক উত্তাপ চড়িয়া গেল, বিদেশ মন্ত্রক ছাত্রদলের ভিসা বরবাদ করিয়া আদেশ দিল পত্রপাঠ দেশে ফিরিয়া যাইতে। ইহা ব্যতিক্রমী ঘটনা বলা যায় না। পাকিস্তান হইতে চিকিৎসার্থে ভারতে আসিতে ইচ্ছুক মানুষদের ক্ষেত্রেও প্রবল ভিসা কড়াকড়ির আদেশ দিয়াছে দিল্লি। এই ক্ষেত্রে সংখ্যাটি আর পঞ্চাশ-ষাট নহে, বহু সহস্র মানুষের জীবন এই এক ঘায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ঠিক কী বার্তা কাহাকে দিতে চাহিতেছে? বোঝা মুশকিল।

কিংবা, বোঝা একেবারেই মুশকিল নয়। বিজেপি সরকার জানে, কিছু মানুষকে ভিসা না দিয়া ভারত-পাকিস্তান বিরোধের মহাকাব্যিক বিস্তারের কোনও সুরাহা হইবে না, সংকটের বিন্দুমাত্র সমাধানও ইহার ফলে উত্থিত হইবে না, রাগ দেখাইলে যে পাক সরকার ভয়ে পোষ মানিবে, এমন সম্ভাবনাও নাই। অর্থাৎ এই পদক্ষেপের একটিমাত্র অর্থ সম্ভব: দেশের মধ্যস্থ ভোটার সমাজকে কিছু বার্তা দেওয়া। সরকারি পাকিস্তানবিরোধিতার একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাধারণবোধ্য উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা। জানাইয়া দেওয়া যে, সরকার কিন্তু বসিয়া নাই, পাকিস্তানি দেখিলেই তাহাদের দফা রফা করিতেছে! বিজেপি নেতারা মিটিং-মিছিলে গলা ফুলাইয়া বলিতে পারিবেন, তাঁহারা কত ‘দৃঢ়’, তাঁহাদের রাষ্ট্রের পৌরুষ কেমন ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাড়িয়া এক দাগও নামে না। সীমান্তে কোনও কার্যকর সামরিক পদক্ষেপ হউক আর না হউক, এই কূটনৈতিক চালে সরকার তাই অত্যুৎসাহী, অতি-সক্রিয়। নির্বাচনী রাজনীতিতে এইগুলির উপযোগিতা দারুণ।

সুতরাং আইএমপিপিএ (ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স প্রোডিউসার্স অ্যসোসিয়েশন) যেমন পাকিস্তানি অভিনেতা অভিনেত্রীদের বিড়াল-কুকুরের মতো বলিউড হইতে তাড়াইয়া হুহু করিয়া নিজেদের হিন্দুত্ববাদী জনপ্রিয়তা বাড়াইল, একই পদ্ধতিতে এমইএ-ও সরকারি জনপ্রিয়তা বাড়াইতে চাহে। এই রাজনৈতিক কূটনীতির ফাঁক গলিয়া প্রধানমন্ত্রী মোদীর কিছু কাল আগে উচ্চারিত সুভাষিতানি (‘পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী আর পাকিস্তানি মানুষের মধ্যে ভারত পার্থক্য রাখিতে চাহে’) কবেই হাওয়ায় মিলাই়য়াছে। বাজপেয়ীর আমল হইতে একটি মিথ চালু: বিজেপি নাকি দুই দেশের মধ্যে ‘মৈত্রী’ সম্পর্কের বিষয়ে বেশি আন্তরিক। তথ্য বলিতেছে, এই আন্তরিকতার কোনও ধারাবাহিকতা নাই। কয়েক মাস আগে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আবহেও বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ চণ্ডীগড়ে আটকাইয়া পড়া কিছু পাকিস্তানি শিক্ষার্থীকে নিজ দায়িত্বে নিরাপদে দেশে ফিরিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। আর আজ মস্তকচ্ছেদনের প্রত্যুত্তরে শয়ে শয়ে ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত হইতেছে। বিজেপির কু-রাজনীতি এই ভাবেই কূটনীতিকে ভাসাইয়া দিতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Voter-oriented diplomacy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE