Advertisement
১১ মে ২০২৪
সম্পাদকীয়

তিষ্ঠ ক্ষণকাল

খ্যাতি ছড়াইবার প্রক্রিয়াটি কী? কারণ অন্বেষণে বিজ্ঞানীগণ যাহার শরণ লন, তিনি মহামতি চার্লস ডারউইন। প্রাণিরাজ্যে টিকিয়া থাকিবার সংগ্রামে যে দুইটি ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন ডারউইন, তাহারা হইল প্রজননক্ষমতা এবং পরিবেশ। যে জীব যত দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করিতে পারে ও বংশবৃদ্ধিতে যত বেশি পরিবেশের সহায়তা পাইয়া থাকে, তাহার জীবনযুদ্ধে জয়ী হইবার সম্ভাবনা তত বেশি।

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৬
Share: Save:

হুজুকপ্রিয় বাঙালির রসনা পরিতৃপ্ত করিতে প্রতি বৎসরের ন্যায় এই শরতেও নূতন ফ্যাশন হাজির। নারীর অঙ্গভূষণ শাড়ি রূপে। শারদোৎসবে এই বার যে শাড়িটি বাজার মাত করিবে বলিয়া শুনা যাইতেছে, তাহার নাম নাকি ‘রানু মণ্ডল শাড়ি’। রানাঘাট শহরনিবাসী রাণু মণ্ডল এক্ষণে ভারতপ্রসিদ্ধা। তাঁহার কণ্ঠ নাকি লতা মঙ্গেশকরের অনুসারী। কতিপয় যুবকের সুনজরে পড়িবার পর হতদরিদ্র শ্রীমতী মণ্ডলের উত্থানপর্ব গল্প-উপন্যাসকেও টেক্কা দিতে পারে। যে গায়িকা এ-হেন খ্যাতির কেন্দ্রে, তাঁহার পরিধেয় শাড়িটিও অনুকরণযোগ্য হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কী। অতএব, ‘রানু মণ্ডল শাড়ি’। যাঁহার কণ্ঠসুধা অনুকরণ করিয়া শ্রীমতী মণ্ডল খ্যাতনাম্নী হইয়াছেন, তিনি এই গায়িকার প্রসিদ্ধির ব্যাপারে একটি মন্তব্য করিয়াছেন। মন্তব্যটি শুনিয়া কাহারও কাহারও ভ্রু কুঞ্চিত হইতে পারে, তথাপি উহার যাথার্থ্য অগ্রাহ্য করা যায় না। শ্রীমতী মঙ্গেশকর যাহা বলিয়াছেন, তাহার মর্মার্থ— নিছক অনুকরণ শিল্পের পর্যায়ভুক্ত হইতে পারে না। অনুমান করা যায়, তিনি বলিতে চাহিয়াছেন, অনুকরণ অনুসারীর মূল্য বুঝায় না, যাহাকে অনুকরণ করা হইতেছে তাহার মহার্ঘতা প্রমাণ করে। ব্যবসার নিয়ম অনুযায়ী বলা যায়, বাজারে যে দ্রব্যের নকল বাহির হয় না, সেই দ্রব্য বিক্রিতে সেরা নহে। বাণিজ্য শিরোধার্য করিয়া ইহাই বলিতে হয় যে, ফ্যাশন হিসাবে ‘রানু মণ্ডল শাড়ি’ অবশ্যই প্রমাণ করে শ্রীমতী মণ্ডলের খ্যাতি, তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে যাহা প্রমাণিত হয়, তাহা হইল শ্রীমতী মঙ্গেশকরের আকাশচুম্বী প্রতিভা।

খ্যাতি ছড়াইবার প্রক্রিয়াটি কী? কারণ অন্বেষণে বিজ্ঞানীগণ যাহার শরণ লন, তিনি মহামতি চার্লস ডারউইন। প্রাণিরাজ্যে টিকিয়া থাকিবার সংগ্রামে যে দুইটি ফ্যাক্টর আবিষ্কার করেন ডারউইন, তাহারা হইল প্রজননক্ষমতা এবং পরিবেশ। যে জীব যত দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করিতে পারে ও বংশবৃদ্ধিতে যত বেশি পরিবেশের সহায়তা পাইয়া থাকে, তাহার জীবনযুদ্ধে জয়ী হইবার সম্ভাবনা তত বেশি। খ্যাতিকেও জীবের সহিত তুলনা করেন বিজ্ঞানীগণ। খ্যাতি এক বিশেষ ধারণা। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাহার নাম ‘মেমে’। ইহার আশ্রয়স্থল মানুষের মন। এক মন হইতে অন্য মনে বিস্তার লাভে নির্দিষ্ট একটি মেমে যত বেশি পারঙ্গম, ততই তাহার প্রসার। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপমা ধার করিয়া বলা যায় মেমে যেন এক ভাইরাস। যত বেশি মানুষের চিন্তাকে তাহা গ্রাস করিতে পারিবে, ততই তাহার টিকিয়া থাকিবার সম্ভাবনা। এই বিচারে সমাজমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ শব্দটি সুপ্রযুক্ত। এক একটি পোস্ট যে ভাবে অতি দ্রুত হস্তান্তরিত হয়, তাহাতে ব্যাধির জীবাণু সংক্রমণের কথা মনে পড়া সমীচীন। এই মাধ্যম বহুজনের নাগালে, অতএব সংক্রমণ ঘটে দাবানলের বেগে। ইহার সুফল ও কুফল দুইই থাকিলেও, তুলনায় কুফলই যেন বেশি। সুফল ইহাই যে, প্রথাগত মাধ্যম কোনও তথ্য প্রকাশে অনাগ্রহী হইলেও সামাজিক মাধ্যমে উহা প্রকাশিত হয়। কুফল হইল মিথ্যা প্রচার। প্রচারয়ন্ত্রটি হাতে থাকায় যে কেহ যে কোনও মুহূর্তে বিভ্রান্তি প্রচারে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রযুক্ত অস্ত্র দুইটির নাম ‘লাইক’ ও ‘শেয়ার’। লাইক করিলে শেয়ার করুন ইত্যাকার অনুরোধে সাড়া দিবার লোকের অভাব নাই। শেয়ার-আগ্রহীর অভাব নাই। লাইকই যখন করা গিয়াছে, তখন শেয়ার করিতে বাধা কোথায়?

সমাজমাধ্যমের কল্যাণে বিভ্রান্তি প্রচারের প্রাবল্যে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট-এর বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ করিতে যাইতেছেন এক জার্নাল। দ্য মিসইনফর্মেশন রিভিউ নামক এই জার্নালে ছাপা হইবে মিথ্যার বেসাতি সম্পর্কিত বিবিধ প্রতিবেদন। কুতথ্য যে হারে চারিদিকে বাড়িয়া চলিয়াছে, তাহাতে এই উদ্যোগে সাধুবাদ প্রাপ্য। বিশেষজ্ঞেরা বলিয়াছেন, জানিয়া-বুঝিয়া কেহ মিথ্যা প্রচার করিতে চাহেন না। যিনি কোনও পোস্ট লাইক করেন, তিনি উহা সত্য বলিয়া ধরিয়া লন। এমতাবস্থায় লাইক বা শেয়ারের সহিত আর একটি আইকন বা বোতামের প্রয়োজন বোধ করেন। কী? ‘পজ়’ অর্থাৎ বিরতি। নির্দিষ্ট পোস্টটি যাহার ভাল লাগিল, তিনি যেন নিজেকে কিঞ্চিৎ প্রশ্ন করিবার সুযোগ পান। তিনি কি মিথ্যা প্রচারের শিকার হইতেছেন? কেহ বা কাহারা কি তাঁহাকে দলে টানিবার চেষ্টা করিতেছে? অতএব লাইক বা শেয়ার করিবার পূর্বে সাবধানবাণী— তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এই পরামর্শ যে সাধু, তাহাতে সন্দেহ নাই। তবে, শতেক সাধু প্রস্তাবের ন্যায় ইহাও যে জলে যাইবে না, তাহা হলফ করিয়া বলা যায় না।

যৎকিঞ্চিত

জন্মদিনে উপহার দিতে হয়। দুশো বছরের জন্মদিন হলে তো কথাই নেই। বাঙালি ঠিক করেছে, বিদ্যাসাগরকে কৃতিত্বের উপহারে ভরিয়ে দেবে। এক জন জানালেন, বিদ্যাসাগর সতীদাহ প্রথা রদ করেছেন। আর এক জন আগেই বলেছেন, বিদ্যাসাগর সহজ পাঠ লিখেছেন। অন্য এক জন বললেন, তিনি মাইল আবিষ্কার করেছিলেন। বীরসিংহের সিংহশিশু নিশ্চয় বিস্ময়ে হতবাক— তাঁর জীবৎকালে বাঙালি তো তাঁকে প্রাপ্য কৃতিত্বটুকুও দেয়নি। দুশো বছরের সুদ জমলে পুঁজি তবে এতখানি বাড়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ranu Maria Mondol Lata Mangeshkar Social Media
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE