মরা ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছেন, এটা বুঝতে পারলে নেমে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু লোকে সে কথা শোনে না, নানা পথ খোঁজে— চাবুকটা পালটায়, আর একটা মরা ঘোড়া নিয়ে আসে, কমিটি বসিয়ে সুপারিশ জোগাড় করার চেষ্টা করে যে, একটা মরা ঘোড়ার চেয়ে দুটোয় বেশি কাজ হয়। ১৯৭২ সাল থেকে মহারাষ্ট্র সরকার রাজ্যে খরার মোকাবিলায় যা করে আসছে, তাতে এই উদাহরণটাই মনে পড়ে। দেশের মধ্যে এই রাজ্যেই বড় সেচ প্রকল্পের সংখ্যা সর্বাধিক (১৮৪৫), অথচ পানীয় জলের সংকট মিটল না। তার কারণ, এই রাজ্যের শাসকরা মরা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে নারাজ। সেই ঘোড়াটির নাম: আখ। যে জিনিসটির চাষে বিস্তর জল দরকার হয়।
কৃষি দফতরের তথ্য অনুযায়ী, মহারাষ্ট্রের ১ কোটি ৩৭ লক্ষ কৃষকের দুই-তৃতীয়াংশই এখন খরাপীড়িত। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মরাঠাওয়াড়া অঞ্চলে, তার পরেই বিদর্ভ। এগুলিই রাজ্যের সবচেয়ে অনুন্নত এলাকা। মরাঠাওয়াড়া পর পর দু’বার খরার কবলে পড়েছে: ২০১৪ সালে বৃষ্টিপাতে ৪২ শতাংশ ঘাটতি ছিল, ২০১৫ সালে ৪০ শতাংশ। ২০১৫’য় মহারাষ্ট্রে সব অঞ্চল মিলিয়ে গড়পড়তা বৃষ্টির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩০০ মিলিমিটার, সর্বভারতীয় গড়ের (১১০০ মিলিমিটার) কিছুটা বেশি। মরাঠাওয়াড়ায় বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ৮৮২ মিলিমিটার, বিদর্ভে ১০৩৪। এর সঙ্গে রাজস্থানের তুলনা করা যাক। রাজস্থানে কোনও বছরেই ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয় না। সুতরাং শুধু অনাবৃষ্টিকে দায়ী করলে ভুল হবে।
২০১৫ সালের একটি রিপোর্টে যোজনা কমিশন বলেছিল, ‘প্রাকৃতিক কারণে জলাভাবের চেয়েও জল যথাযথ ব্যবহারের ত্রুটিই খরার প্রধান কারণ। ১৯৬০ সাল থেকে সরকার গ্রামীণ জল সরবরাহের জন্য ১৬০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে, তা সত্ত্বেও এখনও ২০০০০ গ্রামের সাড়ে চার কোটি মানুষ জলকষ্টে ভোগেন।’ যোজনা কমিশনও এই সমস্যার জন্য আখ চাষে বিস্তর জলের খরচকেই দায়ী করেছে এবং তার পিছনে রাজনৈতিক স্বার্থের কথাও স্পষ্ট ভাবে বলেছে।
চিনির উৎপাদনে সারা দেশে মহারাষ্ট্রের স্থান দ্বিতীয়। রাজ্যে আছে ২০৫টি সমবায়-চালিত এবং ৮০টি বেসরকারি চিনিকল। অধিকাংশ সমবায়ের মালিকানা অথবা নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিকদের হাতে। আখ চাষ হয় মাত্র ৪ শতাংশ জমিতে, কিন্তু সেচ-জলের ৭১.৫ শতাংশ এই একটি চাষে খরচ হয়। কূপের জলও এর মধ্যে আছে। বেশির ভাগ চিনিকল আছে প্রধানত কম-বৃষ্টির অঞ্চলগুলিতে, যেমন পুণে, আহমদনগর, সোলাপুর, সাঙ্গলি। আছে মরাঠাওয়াড়াতেও, যে অঞ্চলটি পর পর দু’বারের অনাবৃষ্টিতে সবচেয়ে বিপন্ন। চিনিকলগুলি হল রাজনীতির চালিকাশক্তি, ফলে প্রত্যেকটি রাজ্য সরকার জলের অতিব্যবহার সম্পর্কে অমার্জনীয় ঔদাসীন্য দেখিয়েছে। আখই এই রাজ্যে একমাত্র কৃষিপণ্য, যা বাজারে বিক্রি করে ভাল লাভ ঘরে তোলার বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, এবং চিনিই একমাত্র কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্য যার উৎপাদনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে প্রচুর কর্মসংস্থান হয়, সংশ্লিষ্ট নানা শিল্পের প্রসার ঘটে। আখের খেত এবং চিনির কল রাজ্যের প্রগতিশীল কৃষকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক।
আইএমডি-র (ভারতীয় আবহাওয়া প্রতিষ্ঠান) ভূতপূর্ব কর্ণধার রঞ্জন কেলকর বলেছেন, মরাঠাওয়াড়া প্রাকৃতিক কারণেই খরাপ্রবণ— আরব সাগরের মৌসুমী বায়ু এই অঞ্চল অবধি পৌঁছনোর আগেই তার প্রায় সব জল ঝরে যায়। বিদর্ভ মরাঠাওয়াড়ার তুলনায় বঙ্গোপসাগরের কাছে, তাই এখানে মৌসুমী বায়ুর অন্য শাখাটি কিছুটা বৃষ্টি আনে। কেলকরের মতে, সীমিত জলসম্পদ কী ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাই আসল প্রশ্ন। অর্থাৎ, বছরে গড়পড়তা যতটা বৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাষের আয়োজন করা উচিত। ঘটনা হল, ভারতে বৃষ্টি হয় বছরে চার মাস, অথচ এখন সারা বছরই চাষের কাজ চলে। আমাদের পূর্বসূরিরা কিন্তু খুব ভাল জানতেন, বছরের ন’মাস কী ভাবে জল ধরে রাখতে হয় এবং সে জল বুঝেশুনে খরচ করতে হয়।
মহারাষ্ট্রের প্রায় নব্বই শতাংশ জমির নীচেই ব্যাসল্ট পাথর। এই পাথরে সূক্ষ্ম ছিদ্র কম, ফলে বৃষ্টিজল চুঁইয়ে চুঁইয়ে মাটির নীচে পৌঁছতে পারে না, তাই খরার প্রবণতা বেশি হয়। ভূমিজল যথেচ্ছ ভাবে তুলে নিলে মরাঠাওয়াড়া মরুভূমি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, অনেক বিশেষজ্ঞই এমন চেতাবনি দিয়েছেন। অথচ এখানে এক দিকে সত্তরটি চিনির কল, অন্য দিকে গ্রামে গ্রামে ট্যাঙ্কারে বা ট্রেনে করে জল পাঠাতে হচ্ছে!
আক্ষেপের কথা, একের পর এক সরকার— কংগ্রেস, সেনা-বিজেপি, কংগ্রেস-এনসিপি, বিজেপি-সেনা— ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কেউ জল সাশ্রয়ের জন্য কৃষির ওপর, বিশেষ করে আখ চাষের ওপর, কোনও নিয়ন্ত্রণ জারির চেষ্টা করেনি। এই কৃষিপণ্যটি বিপুল পরিমাণ জল টানে, অথচ এখনও এর চাষে বিন্দু-সেচ (ড্রিপ ইরিগেশন) আবশ্যিক করার কোনও উদ্যোগ হল না। তার সঙ্গে আছে নগরায়ণের চাপ। নগরায়ণের মাত্রায় মহারাষ্ট্রের স্থান সারা দেশের মধ্যে তৃতীয়— রাজ্যের ৪৫ শতাংশের বেশি মানুষ শহরের বাসিন্দা। শহর মানেই জল সরবরাহ এবং সাফাই ব্যবস্থার বিরাট চাহিদা। এবং বাড়ি তৈরির নিরন্তর মহাযজ্ঞ। জল এবং বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের অনুকূল নকশা উদ্ভাবনের দিকে ভারতীয় নির্মাণ শিল্পের উদ্যোগীরা আজও যথেষ্ট মনোযোগী হননি। আমরা পশ্চিম দুনিয়ার শিল্পোন্নত দেশগুলির ইমারত নির্মাণের নকশা অনুসরণ করছি, অথচ সেগুলি আমাদের দেশের উপযোগী নয়।
এরই মধ্যে সোলাপুর আশার আলো দেখিয়েছে। এই জেলাও চিরকালই খরাপ্রবণ। ২০১৩-১৪ সাল অবধি ভাল বর্ষার বছরেও জেলা প্রশাসনকে পানীয় জল সরবরাহের জন্য দুশোর বেশি ট্যাঙ্কার ভাড়া করতে হত। অথচ এ বার, এই অনাবৃষ্টির বছরে, মাত্র ষোলোটি ট্যাঙ্কার কাজ করছে। এটা কী করে সম্ভব হল? না, অলৌকিক কিছু ঘটেনি। জেলা প্রশাসন কয়েকটা কাজ করেছেন। তাঁরা পানীয় জলের উৎসগুলিকে সুরক্ষিত রেখেছেন, প্রবল উদ্যমে কৃষিজমিতে জলাশয় সংস্কারের কর্মসূচি রূপায়ণ করেছেন, আখ চাষে জলের ব্যবহার কমানোর জন্য নানা পদ্ধতি উদ্ভাবনে উৎসাহ দিয়েছেন, কোনও চিনিকল পানীয় জলের উৎসে দূষণ ঘটালে তাদের জরিমানা করেছেন। এই তৎপরতার অনেকখানি কৃতিত্বের দাবিদার হলেন জেলাশাসক তুকারাম মুন্ডে এবং তাঁর জল সংরক্ষণ ও কৃষি দফতরের তন্নিষ্ঠ সহকর্মীরা। খরাপীড়িত মহারাষ্ট্রের উত্তপ্ত এবং ঊষর ভূমিতে সোলাপুর সত্যিই একটা ঠান্ডা হাওয়ার মতো আরাম দেয়। এই অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দেয়, চিরাচরিত লোকজ্ঞান কতখানি মূল্যবান। সেই জ্ঞান কাজে লাগাতে চাইলে আগে মরা ঘোড়াটির পিঠ থেকে নামতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy