Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Water Crisis

জল সঙ্কটের হাতছানি দুই জেলায়

২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের ভাণ্ডার প্রায় তলানিতে ঠেকে যাবে। যে তালিকার শীর্ষেই রয়েছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদ। জল অপচয় নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে বলছেন রাজীব তন্তুবায়

পুরুলিয়ার একটি গ্রামে। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

পুরুলিয়ার একটি গ্রামে। ছবি: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

রাজীব তন্তুবায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:২৯
Share: Save:

এখনও গ্রীষ্ম আসেনি সেভাবে। জল নিয়ে সর্বত্র যে গেল গেল রব পড়ে যায় সাধারণ মহলে, তা এখন বেশ খানিকটা স্তিমিত। তাই কলের মুখ থেকে হদ্ হদ্ করে জল পড়ে যাওয়া দেখলেও বন্ধ করার বালাই নেই। কারও কারও বন্ধ করার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। কারণ বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বহু গ্রামে পাইপলাইনের জল হয়ত পৌঁছে গিয়েছে, কিন্তু বহু জায়গায় কলের মুখে চাবি নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও জল অপচয় রোধ করা যায় না। নির্বিকার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। কেননা খালি চোখে জল তো পর্যাপ্ত। অতএব চিন্তার কিছু নেই।

সত্যি কি চিন্তার কিছু নেই? শিক্ষিত-সচেতন মানুষ নিশ্চয়ই জানেন শুধু চিন্তাই নয়, কত বড় দুশ্চিন্তার সম্মুখীন আমরা। কত বড় জলসঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছে আমাদের প্রিয় বসুন্ধরা। ভারতবর্ষ‌ও তার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়নি। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রকাশিত নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৬০ কোটি ভারতীয় চরম জলকষ্টের শিকার এবং বছরে প্রায় দু’লক্ষের মতো মানুষ মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে। এই অভাব আরও প্রকট হয়ে উঠবে ২০৩০ সাল নাগাদ, যখন চাহিদা অনুযায়ী পানীয় জলের জোগান প্রায় নিঃশেষিত হয়ে পড়বে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ২১টি শহরে ভূগর্ভস্থ পানীয় জলের ভাণ্ডার প্রায় তলানিতে ঠেকে যাবে। যে তালিকার শীর্ষেই রয়েছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দরাবাদের মতো শহরগুলি। গত বছরই চেন্নাই শহরে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। যেখানে সোনার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে পানীয় জল। জল নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি ভিড়ও তার লম্বা লাইন ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়। অথচ যখন আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, খবরের কাগজে বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা পড়ে বা দেখে তখন শিউরে উঠি ঠিকই, তারপর আবার ভুলেও যাই। কারণ আমাদের প্রয়োজনে তো সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত জল আমরা পেয়ে যাচ্ছি। তাই হয়ত তার বেশি আর ভাবতে পারি না।

কিন্তু এ ভাবনাও যে আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না তারও ইঙ্গিত মিলেছে বিভিন্ন রিপোর্টে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানীয় জলের অভাবে কষ্ট পায় বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ও গঞ্জের মানুষজন। এখনও বহু গ্রাম রয়েছে যেখানে না পৌঁছেছে জলের পাইপলাইন, না রয়েছে নলকূপে পর্যাপ্ত জল। পুরুলিয়ার ঝালদা, বাঘমুণ্ডি, মানবাজার, বরাবাজার, বান্দোয়ান এবং বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, ঝিলিমিলি, রাইপুর, সিমলাপাল, খাতড়া প্রভৃতি এলাকার জলকষ্টের কথা সর্বজনবিদিত। এমনকি, প্রচণ্ড গ্রীষ্মকালে বাড়ির মহিলাদের চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে জল আনতে যাওয়ার কথাও শোনা যায়। পানীয় জল তো দূরের কথা, এমন সময় এসে উপস্থিত হয় যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার পর শৌচকার্য করার জল‌ও মেলে না কোথাও কোথাও।

এই জল সঙ্কটের মূল কারণ এখানকার ভৌগোলিক পরিবেশ। দুই জেলায় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের হার যত না কম, তার চেয়েও কম এখানকার মাটির জলধারণ ক্ষমতা। এক সময় এই এলাকার বেশিরভাগ অঞ্চল‌ই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। সেই জঙ্গল কেটে ফেলার ফলে উপরিভাগের নরম মাটি বৃষ্টির জলে ধুয়ে গিয়েছে। বেরিয়ে এসেছে রুক্ষ-কাঁকুরে মাটি। বর্তমানে যার জলধারণ ক্ষমতা প্রায় নেই। ফলে সারাবছর জলাধারে জল থাকে না বললেই চলে। যতটুকু বৃষ্টি হয়, বিভিন্ন উপায়ে তা ধরে রাখার ব্যবস্থাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। যদিও রাজ্য সরকার ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বৃষ্টির জল ধরে রাখার প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন তুলনামূলক ভাবে খুব একটা চোখে পড়ে না জেলা দু’টিতে। তাই বৃষ্টি হলেও সেই জল ঢালু জমি বেয়ে সরাসরি নদীবাহিত হয়ে চলে যায় বঙ্গোপসাগরে। ফলে ভৌম জলের যে ঘাটতি তা পূরণ হওয়ার সুযোগ খুব একটা পায় না বললেই চলে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে-গঞ্জেও কংক্রিটায়নের পরিমাণ বেড়েছে বহুলাংশে। গ্রামেও এখন পাকা বাড়ি, সিমেন্টের চাতাল, ঢালাই রাস্তা। যা ভূ-অভ্যন্তরে বৃষ্টির জল পৌঁছনোর পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।

কৃষি বিপ্লবের ফলে যেমন বেড়েছে উন্নতমানের ফসল উৎপাদন, তেমনি বেড়েছে কৃষিকার্যে ভৌম জলের অত্যধিক ব্যবহার। যদিও দক্ষিণ বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় কৃষিকার্য তুলনামূলক খুব কমই হয়, তবুও ভৌম জলের ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে সেখানে। বিজ্ঞানীদের মতে, যার ফলে এক দিকে যেমন ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কটকে ত্বরান্বিত করছে, অন্য দিকে নষ্ট হচ্ছে মাটির উর্বরতা শক্তি। এর পাশাপাশি, শিমুল, পলাশের দেশ বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় বনসৃজন এর নামে সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে লাগানো হয়েছে ইউক্যালিপটাস গাছ। একশ্রেণির মানুষ মনে করেন এই গাছ ব্যাপক হারে ভূগর্ভস্থ জল শোষণ করে জলস্তরকে তলানিতে নামিয়ে দিচ্ছে।

সম্প্রতি দুই জেলায় এমন অনেক ইটভাটা তৈরি হয়েছে, যেখানে দৈনিক ডিপ-বোরিং এর মধ্য দিয়ে উঠে আসছে প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল। ভবিষ্যতের জন্য যা আদৌ সুখের কথা নয়। এ ছাড়া বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলিতেও এখন বাড়িতে বাড়িতে বোরিং, ডিপ-টিউবওয়েল। যার বাড়বাড়ন্ত অত্যাধিক। যা দিয়ে যত পরিমাণ ভৌম জল দৈনিক নিঃশেষিত হচ্ছে, তার দশ শতাংশ‌ও ভূগর্ভে প্রবেশ করার সুযোগ থাকছে না। যদিও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় জল মন্ত্রকের কথা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভৌম জল সঞ্চিত রয়েছে। কিন্তু এই ভাবে প্রতিনিয়ত ভূগর্ভস্থ জল উঠে এলে তা শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। এটাই সবচেয়ে বড় সঙ্কট।

তবে সবচেয়ে বড় সঙ্কট, মানুষের সচেতনতার অভাব। আমরা যত না জল প্রয়োজনে ব্যবহার করি, তার চেয়ে অনেক বেশি অপচয় করে থাকি। এই অপচয়‌ই দ্রুততার সঙ্গে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ জল সঙ্কটের দিকে। যা হয়ত আন্দাজ করলেও নিজেদেরকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে পছন্দ করছি অনেকে। তাই অন্যের জল কষ্ট দেখেও অনায়াসে নির্বিকার থেকে যাচ্ছি আমরা। এ যেন সেই প্রবাদকেই মনে করিয়ে দেয়, ‘ঘুটে পোড়ে, গোবর হাসে’।

তাই আর দেরি না করে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভাবে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কমাতে হবে ভূগর্ভস্থ জলের অপচয় তথা যথেচ্ছ ব্যবহার শুধু গ্রীষ্মকালে নয়, সারা বছর ধরেই এই নিয়ে চর্চার প্রয়োজন। আর সবচেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন তা হল ভৌম জল ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তা না হলে চরম জল সঙ্কটের হাত থেকে নিস্তার নেই।

লেখক বাঁকুড়ার ইঁদপুরের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Water Crisis Niti Ayog
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE