‘‘আরে তুই তো বিন্দাস হলিডে মানাচ্ছিস। আমরা ওয়ার্কলোডে পরেশান হয়ে গেলাম। জলদি রিটার্ন কর।’’ এমন বাক্য বাঙালি তরুণ, তরুণীদের মুখে হামেশাই শুনি! সালাম, বরকত, রফিক, জব্বর, শাফিউলদের রক্তটিকা কপালে লাগিয়ে বড় হয়েছি। এ বাক্য কষ্ট দেয়। সুযোগ পেলে বকুনি দিয়ে থাকি। সোশ্যাল মিডিয়াতে গুটিকয়েক বাঙালি প্রতিবাদের ঝড়ও তুলি।
কিন্তু, একলা সময়ে শুনতে পাই, ‘গভীরে যাও। আরও গভীরে যাও’। গভীর রাতে স্বপ্নে আসে ডলি পেনট্রিথ! চেনেন? ডলি মারা যান ১৭৭৭ সালে। সেই সঙ্গে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কর্নিশ ভাষা জানা মানুষ। কিন্তু, এক সময়ে ইংল্যান্ডে অন্যতম প্রচলিত ভাষা ছিল প্রাচীন কর্নিশ ভাষা। স্বপ্নে শুনি বোয়া সিনিয়ার কন্ঠ। তিনি সেই শেষ ব্যক্তি, যিনি আন্দামানের ‘বো’ ভাষায় কথা বলতেন। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ওঁর মৃত্যুর সঙ্গে ‘বো’ ভাষাও হারিয়ে যায়। ওঁরা কানে কানে বলেন, ‘‘জানো কি? প্রতি দু’সপ্তাহে পৃথিবীতে একটা করে ভাষার মৃত্যু হয়!’’
ভাষার মৃত্যু কাকে বলে ? কোনও ভাষায় কথা বলা শেষ লোকটির মৃত্যু মানেই ভাষার মৃত্যু। ১৯৯২ সালে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ হান্স জুর্গেন স্যাসে তাঁর, ‘‘ভাষার মৃত্যুর তত্ত্ব’’ গবেষণাটি প্রকাশ করেছিলেন। আজ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সেই তত্ত্বটি উল্টে দেখার দরকার। উপনিবেশোত্তর ভারতে, জীবিকার প্রয়োজনে ইংরেজি অনুরক্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল। কিন্তু, শুধু সেই প্রবণতা দিয়েও মাতৃভাষার বর্তমান দুর্গতিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এই জন্যই স্যাস-এর তত্ত্বে চোখ বোলানো। আগে ভাবা হত, দ্বিভাষিক হলে বুঝি কোনও একটি ভাষা অবহেলিত হয়। চিকিৎসা ও ভাষাবিজ্ঞান প্রমাণ করছে, একটি ভাষা অন্যের সম্পূরক, শত্রু নয়। একাধিক ভাষা আয়ত্তে থাকলে, মস্তিষ্কে বুদ্ধির বিকাশ ঘটে বেশি। কোনও একটি ভাষা, কখনই অপর ভাষাকে এক্কেবারে মেরে ফেলে না। বাস্তব উদাহরণ হাতের নাগালেই আছে। আমাদের (ধরা যাক ‘ক’ প্রজন্ম) সবার পরিবারের পরের প্রজন্ম (‘খ’ প্রজন্ম) কেউ না কেউ থাকে বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, পুণে অথবা চেন্নাই। পেশা ও অর্থনৈতিক কারণে যা এড়ানো অসম্ভব। সে সব জায়গায় অফিসে, বাজারে, পথেঘাটে, সামাজিক মেলামেশায় তাঁকে ব্যবহার করতে হচ্ছে ইংরেজি অথবা হিন্দি। বাংলা খুব কম, হয়তো মুষ্টিমেয় বন্ধুর সঙ্গে বা বাড়িতে। এই প্রজন্মের জীবনসঙ্গী যদি বাংলাভাষী না হন, পরিবারটি যদি অভিবাসীই থেকে যান, তা হলে, বাড়িতেও বাংলা পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলবে। এই অবস্থাকে বলে, ‘ভাষা পরিবর্তন’ বা ‘ল্যাঙ্গুয়েজ শিফট’। এ বার তার পরের প্রজন্ম, ‘গ প্রজন্ম’ এল। তাঁরা ‘ক’ ও ‘খ’ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে বাংলা কিছুটা শিখল, হয়তো বলতেও পারে। কিন্তু, তাঁদের ভাষার মধ্যে ভীষণ ভাবে ঢুকে পড়ল অন্য ভাষা। বাংলা ক্রমে হারিয়ে যেতে লাগল। একে স্যাস-এ বলেছেন, ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ডিকে’ বা ‘ভাষার ক্ষয়’।
কেউ বলবেন, অন্য ভাষার শব্দ অপর ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। তা ঘটে তখনই, যখন শব্দেরা হাত ধরাধরি করে বন্ধু হয়ে চলে। যখন অন্য ভাষার শব্দকে উৎখাত করে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে না। শুধু বাংলা ভাষাই নয়, একই ঘটনা কিন্তু ঘটে চলেছে অন্য সব ভাষার পরিবারে। ভারতে এখন ২২টি মুখ্য ভাষা ব্যবহৃত হয়। কথ্যভাষা ১৯,৫০০টি। কে বলতে পারে, কার ভবিষ্যতে, কোন কৃষ্ণগহ্বরে ওত পেতে আছে। ওই ‘গ প্রজন্ম’-এর পরে অনুঃস্বর, বিসর্গ প্রজন্মে কার মাতৃভাষা সম্পূর্ণ মৃত (ডেথ অব আ ল্যাঙ্গুয়েজ) বলে ঘোষিত হবে? কেমন সে বিধিলিপি? আমরাও কি সে দিকেই এগিয়ে চলেছি।
কোনও ভাষার মৃত্যুর আগে, তার এই বিপন্নতাকে শনাক্ত করার কিছু সূত্র আছে। প্রথম ধাপ, বিপন্নতা প্রবণ। একটি ভাষার মধ্যে প্রচুর অন্য ভাষা ঢুকে পড়ছে। দ্বিতীয় ধাপ, শিশুরা সেই ভাষা খুব কম শিখছে। তৃতীয় ধাপ, রীতিমতো বিপন্ন। যখন সেই ভাষায় কথা বলা সব মানুষের বয়স পঞ্চাশের উপরে। চতুর্থ ধাপ, মৃতপ্রায়। শুধু বৃদ্ধরাই ভাষাটি জানেন। এ কথা বলার কারণ, রোগ শনাক্ত করে যদি ঠিক সময়ে নিরাময়ের চেষ্টা করা যায়, তা হলে ভাষাটি বেঁচে যেতে পারে। নিরাময়ের ব্যবস্থা হতে পারে উপরস্তর থেকে, সরকারি ভাবে চেষ্টার মাধ্যমে। আর মানুষের অন্তরের তাগিদে। একটা ভাষা যখন মরে, তখন আঁচলে বেঁধে নিয়ে যায়, সেই অঞ্চলের সনাতন খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, আচার, আচরণ... ধীর লয়ে ভাষার মৃত্যু ঘটলে, তা চোখ এড়িয়ে যেতেও পারে। আবার কখনও ঝটিতি আক্রমণে, ভাষার ‘হত্যা’ও হয়। এর কুখ্যাত নিদর্শন, তাসমেনিয়া বৃটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময়ে ‘কালো যুদ্ধ’। ১৮২৭ থেকে ১৮৩২ সাল, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার বছরের পুরনো মানববসতি, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী তাসমেনিয়ানদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল পৃথিবীর কত পুরনো একটি ভাষাও। স্বাধীনতার পরে পশ্চিম পাকিস্তানের জিন্নার সরকার, রাতারাতি উর্দু ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্দেশ জারি করে। শেষ পর্যন্ত, বাংলার ভায়েরা রক্তের বিনিময়ে তা রুখলেন। তাই ১৯৯৯ সালে, ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভাষা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই শতাব্দীর শেষে প্রচলিত অর্ধেক ভাষার মৃত্যু সুনিশ্চিত। ভাষা বৈচিত্র্যের রামধনু রং মুছে গেলে পৃথিবীটা ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে, কোনও ভাষা ‘মৃতপ্রায়’ চিহ্নিত হওয়া মাত্র, চেষ্টা শুরু করতে হবে। চটপট সেই ভাষার সংরক্ষণযোগ্য লিপি তৈরি করে ফেলতে হবে। তার পরে অভিধান, ব্যাকরণ। সঙ্গে অবশ্যই, সেই ভাষায় কথা বলা মানুষের কথা রেকর্ড করে রাখতে হবে। পাঠ, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা— নানা মাধ্যমে সেই ভাষাকে ব্যবহারে উৎসাহিত করা। এ ধরনের চেষ্টার একটি সফল উদাহরণ, নাইজেরিয়ার প্রাচীন এনজেরেপ ভাষা। ২০১২ সাল নাগাদ দেখা গেল, মাত্র চার জন এই ভাষা জানেন। তাঁদের সবার বয়স ষাটের উপরে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই ভাষাটিকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি, সেই ডলি পেনট্রিথের কর্নিশ ভাষাকেও পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে।
আমরাও বাংলাকে মরতে দেব কেন? শিশুকে জড়িয়ে মায়ের, ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’ বা প্রেমিকার মুখে, ‘তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ’-এর বিকল্প কি ‘আই লাভ ইউ’ হতে পারে?
লেখক দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী