স্কুলে ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন। ফাইল ছবি
মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের শিক্ষার জন্য, স্কুলছুটের হার কমাতে নেওয়া হয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। এই প্রকল্প ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত হয়েছে। মেয়েরা স্কুলে যাতে ভাল পরিবেশ পায় সে জন্যও বেশ কিছু কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য স্কুলে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার বন্দোবস্তও করা হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের ঋতুস্রাব সম্পর্কে সচেতনতা প্রসারের জন্য আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে, এ কথা অনেক শিক্ষাকর্মীই স্বীকার করেন। একটি মেয়ে যখন ১১-১২ বছরে পা রাখে তখন থেকেই তাকে নানা শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ঋতুস্রাব তেমনই একটি শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিষয়টি সম্পর্কে প্রাথমিক ভাবে কোনও ধারণা না থাকায় মেয়েটি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে মেয়েটি এই সময় লজ্জা এবং আতঙ্কে টানা চার-পাঁচদিন স্কুলে আসে না। অনেকে নিজের পরিজনদের কাছ থেকেও সমস্যাটি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদ্যালয়ে টানা চার-পাঁচদিন অনুপস্থিত থাকায় সে পড়াশোনার ক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়ে পড়ে। মেয়েদের এই সমস্যার মোকাবিলায় স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং তার পরিবার পরিজনদের যৌথ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাঁদেরই দায়িত্ব নিয়ে মেয়েটিকে বোঝাতে হবে যে, এটি কোনও অসুখ নয়, বরং বেড়ে ওঠার জন্য একান্ত আবশ্যক একটি শর্ত।
প্রশ্ন হল, মেয়েদের সচেতনতা প্রচারের জন্য না হয় নির্ধারিত সময়ের আগে থেকেই স্কুলে কাউন্সিলিং এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচির বন্দোবস্ত করা হল, কিন্তু তাদের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য আমাদের কী করণীয়? কারণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেকেই এ কথা স্বীকার করেন, বর্তমানে আমাদের রাজ্যের মেয়েদের একটি বড় অংশেরই স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার ক্ষমতা নেই। স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে সচেতনতা এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে সে বিষয়ে একাধিক সমীক্ষা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মেয়েই ঋতুস্রাবের সময় কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করে। স্কুল-ছাত্রীরাও এই প্রবণতার শিকার। তাই মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার পাঠ দেওয়ার জন্য স্কুলগুলিতে স্বাস্থ্যসম্মত উন্নতমানের ন্যাপকিন সরবরাহ এবং তা ব্যবহারের জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়াটা একান্ত প্রয়োজন। তারই সঙ্গে প্রয়োজন, যে আশাকর্মীরা ছাত্রীদের কাছে ন্যাপকিনগুলি পৌঁছে দেবেন তাঁদের বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকাও। এই সময় তাঁরা ছাত্রীদের কী ভাবে সচেতনতার পাঠ দেবেন সে বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করারও দরকার রয়েছে।
বর্তমানে রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি ‘স্বাস্থ্য জেলা’র ঘোষণা করেছে। রামপুরহাট এবং ডায়মন্ড হারবারের মতো স্বাস্থ্য জেলায় সুলভে ন্যাপকিন পৌঁছে দেওয়া যায়, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। আশা করা যায়, আগামী দিনগুলিতে রাজ্যের বাকি অংশও এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য জেলায় বিধিসম্মত ন্যাপকিন প্যাড সরবরাহ করা হচ্ছে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ঘোষিত জেলাগুলিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন স্বাস্থ্য দফতর নির্ধারিত ভেণ্ডার থেকে জেলার ডেপুটি সিএমওএইচ হয়ে ব্লক মেডিক্যাল অফিসে যাচ্ছে। সেখান থেকে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়ে আশাকর্মীদের মারফত পৌঁছে যাচ্ছে পড়ুয়াদের কাছে। এই সরবরাহ চক্র যাতে আরও কার্যকরী হয়ে ওঠে সে দিকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে ন্যাপকিনের প্যাকেটের উপরে তার ব্যবহার বিধি বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজিতে ছাপার প্রয়োজন রয়েছে। যাতে ছাত্রীরা ন্যাপকিনের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।
ন্যাপকিন বিলির পাশাপাশি, মেয়েরা যাতে ঋতুস্রাবের সময়ে পর্যাপ্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার পায় সে দিকে নজর দেওয়া আবশ্যক বলে চিকিৎসকদের মত। ঋতুস্রাবের সময়ে মেয়েদের ফল, আনাজ, ডাল, দুধ এবং অতি অবশ্যই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার সরবরাহের প্রয়োজন। মিড-ডে মিলে এই উপাদান সুষম মাত্রায় উপস্থিত রয়েছে কি না সে বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন। এখন আয়রনের অভাব দূর করার জন্য সরকারের তরফে ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে। এর উপরেও নজরদারির প্রয়োজন।
চিকিৎসকেরা জানান, এই সময়ে ছাত্রীদের উপরে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। তাই তারা যাতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সুস্থ পরিমণ্ডল পায় সে দিকে নজর রাখা একান্ত জরুরি। বিদ্যালয়ে মেয়েদের শরীরচর্চার জন্য যে বন্দোবস্ত রয়েছে, খেয়াল রাখতে হবে এই সময় মেয়েরা যেন কোনও ভাবেই তা থেকে সরে না আসে। তারই সঙ্গে এই সময় পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য করণীয় বিষয় সম্পর্কেও প্রাথমিক পাঠ দিতে এগিয়ে আসতে হবে স্কুলকেই। নিয়মিত ন্যাপকিন পরিবর্তন, সংক্রমণের আশঙ্কা এড়িয়ে চলতে হলে কী করতে হবে সে সম্পর্কেও পড়ুয়াদের প্রয়োজনীয় পাঠ দিতে হবে।
আমরা সকলেই জানি যে, ন্যাপকিন একবারের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে হলে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাও প্রয়োজন। আবার তারই সঙ্গে প্রয়োজন ব্যবহৃত ন্যাপকিনগুলিকে ঠিক স্থানে ফেলা। কিন্তু সমস্যা হল, এ বিষয়ে পড়ুয়াতো দূরের কথা অভিভাবদের একটা বড় অংশই সচেতন নন। তাঁদের অনেকেই এই সময় নিজেদের ‘অশুচি’ বলে ভাবতে অভ্যস্ত। সেই ভাবনা সংক্রমিত হয় তাঁদের সন্তানদের মধ্যেও। ফলে প্রয়োজনীয় সচেতনতা মেনে না চলায় পরে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই সমস্যার সমাধান করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা ও অভ্যাসের যুগপৎ বদলই পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীকে সুস্থ এবং সুন্দর জীবন উপহার দিতে।
বিসিডিএন উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy