Advertisement
E-Paper

আগে পশ্চিমবঙ্গ, তার পর অন্য স্বার্থ

যদি দ্রুত ভারী শিল্পে নিয়োগ না আসে, যদি পরিষেবা ক্ষেত্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ না ঘটে, তবে থাকবে হতাশা এবং বেকারত্বের জ্বালা। সেই হতাশা থাকলে চলবে তোলাবাজি, গুন্ডামি আর সিন্ডিকেটের রাজত্ব।পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিকাশ এবং শিল্পায়নের কথা আলোচনা করার সময় একটি প্রশ্ন বার বার আসে: আমাদের রাজ্যের অতীত কি আমাদের ভবিষ্যতের থেকে উজ্জ্বল?

রূপেন রায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৪৪
একটি সম্ভাবনার মৃত্যু। সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর পরিত্যক্ত কারখানা।

একটি সম্ভাবনার মৃত্যু। সিঙ্গুরে টাটা মোটরস-এর পরিত্যক্ত কারখানা।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিকাশ এবং শিল্পায়নের কথা আলোচনা করার সময় একটি প্রশ্ন বার বার আসে: আমাদের রাজ্যের অতীত কি আমাদের ভবিষ্যতের থেকে উজ্জ্বল? কেন আমরা আমাদের ঐতিহাসিক গৌরব আর ঐতিহ্য নিয়ে এত ব্যস্ত, যখন শিল্পে এবং অর্থনীতিতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি?

তথ্য কী বলে? ষাটের দশক পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। আর একটু পিছনে গেলে চল্লিশের দশকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উৎপাদন ছিল তৎকালীন বোম্বাই রাজ্যের সমান। মনে রাখতে হবে, বোম্বাই রাজ্য তখন ছিল অখণ্ডিত, অর্থাৎ এখনকার মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত দুই রাজ্যের উৎপাদন ছিল বোম্বাই রাজ্যের মোট উৎপাদন। সেখান থেকে নামতে নামতে আমরা অনেকটা নীচে চলে গেছি।

কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি সেই প্রবাদের ব্যাঙের মতো। যদি ব্যাঙকে একটি ফুটন্ত গরম জলের সংস্পর্শে আনা যায়, তবে সে লাফিয়ে পালায় অচিরেই। কিন্তু তাকে যদি ঠান্ডা জলের গামলায় রেখে অল্প আঁচ দিয়ে আস্তে আস্তে সেদ্ধ করা হয়, তা হলে বেচারা ব্যাঙ সহ্য করতে করতে প্রাণ হারায়।

এ রাজ্যের অর্থনীতি এখনও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে আমাদের জনসংখ্যা ১০২৯, যা গুজরাত বা তামিলনাড়ুর থেকে অনেক গুণ বেশি। অতএব, শিল্পায়ন না হলে রাজ্যে কর্মসংস্থান হবে না এবং বেকারত্ব না ঘুচলে গুন্ডামি, তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট রাজের অবসান ঘটবে না। বেকারত্বের পরিসংখ্যান আশঙ্কাজনক। গুজরাতে শহরাঞ্চলের বেকারত্ব ১৮ শতাংশ, গ্রামে ৭ শতাংশ। রাজস্থানে সেই অনুপাত ২১ ও ৪ শতাংশ। মধ্যপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশ অন্ধ্রপ্রদেশ হরিয়ানা মহারাষ্ট্র, গুজরাত তামিলনাড়ু রাজস্থান কর্নাটক, সবাই আমাদের থেকে এগিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে শহরাঞ্চলের বেকারের অনুপাত ৪০ শতাংশ, গ্রামে ১৯ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান আমার নয়, ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে নেওয়া। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমাদের ছেলেমেয়েরা রাজ্যে চাকরি পাচ্ছেন না, ভিন রাজ্যে বা দেশে তাঁদের যেতে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে।

বর্তমান সরকার ভারী শিল্পের লগ্নি আনতে না পেরে দাবি করছেন যে, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প থেকেই নাকি সব কর্মের সৃষ্টি, অতএব ভারী শিল্পের দরকার নেই। কথাটা অর্ধসত্য। অর্ধসত্য অনেক সময় মিথ্যার থেকেও সাংঘাতিক হয়।

জার্মানির মেরুদণ্ড হল মিটেলস্টান্ড বা মাঝারি উদ্যোগ। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেই মাঝারি শিল্প হল বৃহৎ শিল্পের অনুসারী। ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প স্বয়ম্ভূ নয় যে, মরুভূমির মধ্যে ক্যাকটাসের মতো গজিয়ে উঠবে। শিল্পের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে বৃহৎ শিল্পের লগ্নি আসে।

দু’টি উদাহরণ দেওয়া দরকার। একটি সাফল্যের, অন্যটি বিপর্যয়ের। হলদিয়ায় মিটসুবিশি ও দ্য চ্যাটার্জি গ্রুপ দু’টি বৃহৎ শিল্প স্থাপন করেছিল। অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সে দু’টি চালু আছে। ওই দু’টি বৃহৎ লগ্নির কাঁধে চেপে অনেক ক্ষুদ্র শিল্পের জন্ম হয়েছে। কিন্তু অন্য একটি উদাহরণ পশ্চিমবাংলার শিল্পসহায়ক ভাবমূর্তিকে ম্লান করেছে: টাটার সিঙ্গুর প্রকল্প। একটি বণিকসভার সভাপতি হিসেবে যখন প্রতিনিধি দল নিয়ে চিন, জাপান, মায়ানমার, ইংল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর গিয়েছি, তখন একান্তে আলোচনা হলেই একটাই প্রশ্ন উঠেছে: টাটার মতো বৃহৎ এবং সৎ গোষ্ঠী যদি পশ্চিমবঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তা হলে বিদেশিদের ঝুঁকি তো আরও অনেক বেশি।

যদি একটি গাছে পাঁচটি পাখি বসে থাকে এবং একটি শিকারি এসে একটি পাখিকে গুলি করেন, তা হলে বাকি থাকে ক’টি পাখি? পাটিগণিতের হিসেবে চারটি পাখি। কিন্তু লগ্নিকারীদের হিসেবে— শূন্য। কারণ, একটি পাখি শিকার হলে বাকি চারটি ভয়ে উড়ে পালাবে। সিঙ্গুরে যে ভাবে আমরা নিজের নাক কেটে বামপন্থী সরকারের যাত্রাভঙ্গ করেছি, সেই ভাবমূর্তি এবং শিল্পায়নের সদিচ্ছার প্রশ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে সময় এবং পরিশ্রম লাগবে।

এ বার বৈদ্যুতিন শিল্পে আসা যাক। তথ্যপ্রযুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গ দেরিতে হলেও দৌড়ে নেমেছিল। এই শিল্প প্রত্যক্ষ ভাবে প্রায় দু’লাখ কর্মের সংস্থান করেছে এবং পরোক্ষ ভাবে অন্তত আট লাখ। অনেক আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রযুক্তির সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে আছে। যেমন আইবিএম, এরিকসন, ক্যাপজেমিনি, কগনিসান্ট, অ্যাকসেনচিয়র, প্রাইসওয়াটারহাউস, ডেলয়েট এবং কেপিএমজি। দেশের বৃহৎ সংস্থার মধ্যে আছে টিসিএস এবং উইপ্রো। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটছে না। তার মূলত তিনটি কারণ আছে।

১) বেশ কয়েকটি প্রকল্প থমকে গেছে। ইনফোসিস জমি নেওয়ার পরেও পিছিয়ে গেছে, একটি ইটও গাঁথেনি। উইপ্রো-র সম্প্রসারণ বন্ধ। তার প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে এবং আবাসন শিল্পে। বিধাননগর সেক্টর ফাইভ এবং রাজারহাটে কয়েক লক্ষ বর্গফুটের আবাসন ফাঁকা পড়ে আছে।

২) প্রতি কয়েক বছরে নতুন প্রযুক্তির ঢেউ আসে এবং নতুন উদ্ভাবন ঘটে বৈদ্যুতিন শিল্পে। পশ্চিমবঙ্গের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প সেই পুরনো মডেল অবলম্বন করে চলেছে, নতুন প্রযুক্তির হাওয়া এখন বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদে।

৩) প্রযুক্তির নবীনতম ঢেউ হল স্টার্ট-আপ বা নতুন গড়া উদ্যোগ। এর জন্যে চাই নবীন উদ্যোগপতি, যাঁর উদ্ভাবন এবং সৃজনশীলতার দ্বারা ব্যবসায়িক মডেলের নব প্রবর্তন হবে। এই উদ্যোগ শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু পরিকাঠামো এবং বাতাবরণের অভাবে আমাদের রাজ্য পিছিয়ে আছে। টিভিতে রিয়ালিটি শো করলে গায়ক এবং অভিনেতা উঠে আসতে পারে, কিন্তু স্টার্ট-আপ ব্যবসার জন্য চাই ভেঞ্চার পুঁজি, বাজার, মন্ত্রণা এবং সাহায্য। ‘এগিয়ে বাংলা’র মতো রিয়ালিটি শো-তে মানুষ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখার সুযোগ পাবেন, প্রচার হবে এবং ঢাকঢোল বাজবে, কিন্তু কাজে হবে অষ্টরম্ভা। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন উপত্যকায় অনেক সাহায্যকারী সংস্থা আছে, যারা নতুন ধারণার ডিম ফুটিয়ে স্টার্ট-আপ’দের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। তারা সুমন্ত্রণা দেয়, সুপরামর্শ দেয়, ভেঞ্চার পুঁজি (ঝুঁকি নিয়ে নতুন ধরনের ব্যবসা করার জন্য লগ্নি করা পুঁজি) পেতে সাহায্য করে, কিন্তু কোনওটাই উজ্জ্বল আলোর নীচে কিংবা ক্যামেরার সামনে নয়। সব নতুন ধারণাই মূল্যবান এবং উদ্যোগপতিরা মোটেই চান না তাঁদের উদ্ভাবনকে কেউ চুরি করুক। সেই জন্য এই শিল্পে রেয়াজ আছে গোপনীয়তার (নন-ডিসক্লোজার) চুক্তি সই করার।

বৃহৎ লগ্নি না আসার ফলে এবং তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণের অভাবে নতুন কর্মসুযোগ তৈরি হচ্ছে না আর পুরনো শিল্পের রুগ্‌ণতার জন্য কর্মসুযোগ ধ্বংস হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে চা-বাগানের কাজে যুক্ত। প্রতিটি পরিবার প্রায় ৪ জনের। সুতরাং, প্রায় ২৮ লক্ষ মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে। নতুন বিনিয়োগ এবং সুপরিকল্পনার অভাবে অনেক চা-বাগান রোগগ্রস্ত। সব চা-বাগান নয়, কিছু। যে সব বাগানে মালিকরা নিয়োগ করে এসেছেন, সেচের সুব্যবস্থা করেছেন, রিপ্লান্টিং করেছেন, মাটির যত্ন করেছেন, সেখানে চায়ের উৎপাদন ও মালিকের লাভ হচ্ছে। যেখানে সোনালি ডিম পাড়া হাঁসটির গলা মটকে শেষ করা হচ্ছে, সেখানে বাগান বন্ধ হচ্ছে, অনাহারে এবং বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন চা-শ্রমিক। চা শিল্পে রাজনীতি ভুলে যদি সমস্ত গণধারকরা (স্টেকহোল্ডার) একসঙ্গে বসে সমাধানের সূত্র না বের করেন, তবে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ সঙ্গিন।

সবাই বলেন, ভারতের এবং পশ্চিমবঙ্গের সুদিনের বীজ আছে আমাদের যুবশক্তির মধ্যে। আমরা নাকি অচিরেই ডেমোগ্রাফিক লভ্যাংশ পাব, এটাই আমাদের স্বপ্ন। কিন্তু যদি এই যুবশক্তি চাকরি বা জীবিকা না পায়, তবে সে স্বপ্ন পরিণতি হবে দুঃস্বপ্নে। আমাদের কৃষি লাখ লাখ কাজ সৃষ্টি করতে পারবে না। যদি দ্রুত ভারী শিল্পে নিয়োগ না আসে, যদি ব্যাপক শিল্পায়ন না হয়, যদি পরিষেবা ক্ষেত্রের ব্যাপক সম্প্রসারণ না ঘটে, তবে থাকবে হতাশা এবং বেকারত্বের জ্বালা। সেই হতাশা থাকলে চলবে তোলাবাজি, গুন্ডামি আর সিন্ডিকেটের রাজত্ব। শিল্পায়ন নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। যখন সমুদ্রমন্থন হয়েছিল, তখন দেবতা আর অসুররা সমবেত ভাবে অমৃতকুম্ভের সন্ধানে কাজ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক সংকট মোচনের পথ একটাই— সমস্ত রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে শিল্পায়নের ব্যাপক কর্মকাণ্ডে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। সংকটের সময় লন্ডনবাসীরা স্লোগান তুলেছিলেন ‘লন্ডন ফার্স্ট’। আগে লন্ডন, তার পর আর সব স্বার্থ। আমাদের বলতে হবে, এগিয়ে বাংলা নয়, আমরা পিছিয়ে আছি। তাই, আগে পশ্চিমবঙ্গ, তার পর রাজনীতি বা অন্য স্বার্থ।

উপদেষ্টা সংস্থা ‘সুমন্ত্রণা’র কর্ণধার

West Bengal TATA Singur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy