Advertisement
১০ মে ২০২৪
কেন্দ্রের দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা: রাজ্যের কী করা উচিত

উচ্চ শিক্ষার দায়দায়িত্ব

শিক্ষার এই সঙ্কোচন ও লঘুকরণের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর পন্থা আমাদের বিদ্বৎসমাজ আজও ভেবে ওঠেননি, এটা তাঁদের ব্যর্থতা।

বিক্ষুব্ধ: শিক্ষায় বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে নয়াদিল্লিতে পদযাত্রা। ২৮ মার্চ। ছবি: পিটিআই

বিক্ষুব্ধ: শিক্ষায় বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে নয়াদিল্লিতে পদযাত্রা। ২৮ মার্চ। ছবি: পিটিআই

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৮ ০০:২২
Share: Save:

মানবসম্পদ মন্ত্রক ওস্তাদের চাল চেলেছে। দেশের যে অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতি তাদের প্রবল বিতৃষ্ণা, একটা স্বপ্নময় উদারগন্ধি প্রস্তাবে তাদের দোটানায় ফেলেছে। বিতৃষ্ণার কারণ কী? একটা অবশ্যই এই শিক্ষাপ্রাঙ্গণগুলিতে বামপন্থার প্রাদুর্ভাব। আর এক কারণ, হাজার হলেও শিক্ষার পরিবেশে যুক্তি-তথ্য-অনুসন্ধিৎসার একটা আবহ থাকে, স্বৈরাচারী শাসকের পক্ষে যা অস্বস্তিকর। সবচেয়ে বড় কারণ, স্বাধীনতার প্রথম পঞ্চাশ বছর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি আনুকূল্যে সব শ্রেণির ছাত্র অল্প খরচে এক প্রতিষ্ঠানে একই শিক্ষা পেত। সহস্র ত্রুটি সত্ত্বেও লক্ষ্য ছিল সামাজিক ন্যায় ও জাতীয় মানবসম্পদ সৃষ্টি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আজও সেই চরিত্রটা বহুলাংশে ধরে রেখেছে। এ দিকে বছর বিশ হল উচ্চ শিক্ষাকে দেখা হচ্ছে অন্য চোখে— ব্যক্তিগত উন্নতির সোপান হিসাবে, অতএব ব্যক্তিবিশেষের নিজের কড়ির সওদা, অতএব প্রধানত বিত্তশালীর অধিকার। উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থকরী বিদ্যার প্রশিক্ষণ, ব্যাপকতর চিন্তা-গবেষণা নয়— জ্ঞানতন্ত্র (নলেজ অর্ডার) নয়, জ্ঞানাশ্রয়ী অর্থনীতি (নলেজ ইকনমি)।

শিক্ষার এই সঙ্কোচন ও লঘুকরণের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর পন্থা আমাদের বিদ্বৎসমাজ আজও ভেবে ওঠেননি, এটা তাঁদের ব্যর্থতা। কিছু কাগুজে আলোচনা হয় (যেমন এই প্রবন্ধ)। তার বাইরে আমাদের উপজীব্য কেবল প্রতিবাদ, যার মূল উপকরণ স্লোগান-মিছিল-অবরোধ, কখনও তজ্জনিত হিংসা বা অনাচার।

হতে পারে এই প্রতিবাদের গূঢ় দর্শন জনদরদি, কিন্তু সাধারণ লোকে তা ভাল চোখে দেখেন না। সত্যিকারের সঙ্কট হলে আলাদা কথা, তার সাক্ষ্য হোক কলরব আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন। অত নাটকীয় পরিস্থিতি বড় ঘটে না। সাধারণ মানুষ ভাবেন তাঁদের তুলনায় শিক্ষকরা তো বটেই, ছাত্ররাও যথেষ্ট সুবিধাভোগী, তাঁদের সফল জীবন ও চিন্তাবিলাস সুনিশ্চিত করতে জনগণ টাকা জোগান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকে তাঁরা দেখেন তির্যক দৃষ্টিতে। ছাত্র-মিছিলের জনমুখী স্লোগানে বাসে-আটক যাত্রী আপ্লুত হন না। যে গরিবের সন্তান তৃতীয় শ্রেণিতে স্কুলছুট, ভাগ্যবান তরুণদের আস্ফালনে তিনি ক্ষোভ বা অবজ্ঞা বোধ করেন। আবার মধ্যবিত্ত সমাজের একমাত্র চাহিদা, তাঁদের সন্তানরা নির্বিঘ্নে ডিগ্রির বেড়া ডিঙিয়ে দুধে-ভাতে থাকবে; ইনডিসিপ্লিন তাঁদের দু’চক্ষের বিষ, হেতু যা-ই হোক না কেন।

যে চতুর শাসকরা শিক্ষাব্যবস্থাকে কব্জা করতে চায়, জনমানস তারা ভালই বোঝে এবং সারস্বত সমাজকে শায়েস্তা করতে নিপুণ ভাবে কাজে লাগায়। কোনও অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে হঠকারী নীতি ও অপশাসন কায়েম করে এরা পরিকল্পিত ভাবে প্রতিবাদ উস্কে দেয়। ২০১৪-য় যাদবপুরে এমন প্রচেষ্টা রোধ করা গিয়েছিল, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সত্তায় একটা স্থায়ী ক্ষত রেখে। একটানা প্রবল চেষ্টা চলছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে; জনতার চোখে কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকরাই প্রতিপন্ন হচ্ছেন দেশদ্রোহী হামলাবাজ হিসাবে, লেখাপড়া শিকেয় তুলে যাঁরা ক্লাস ফাঁকির দাবিতে রাস্তায় নামেন। সবচেয়ে চিন্তার কথা, এই আলোড়নে আসল পঠনপাঠনের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে, হতে বাধ্য। এমন চলতে থাকলে এক দিন প্রতিষ্ঠানটি সত্যিই তলিয়ে যাবে— সেখানকার বিশিষ্ট শিক্ষকরা সে আশঙ্কাই করছেন। মধ্যবিত্ত সমাজ সে দিন বলবে, ‘পলিটিক্স করে জায়গাটা গোল্লায় গেল।’ চরিতার্থ শাসককুলের আসল রাজনীতি নেপথ্যে থাকবে, বলির পাঁঠা হবেন ছাত্র-শিক্ষকের দল।

এ বারের চ্যালেঞ্জটা উল্টোমুখী। এই বেয়াড়া বিদ্যায়তনগুলি নিয়ে কর্তাদের একটা সমস্যা: লেখাপড়া-গবেষণায় এরা দেশের সেরা, কেবল অপশাসন আর অশান্তি বাধিয়ে সেই উৎকর্ষ ধ্বংস করতে সময় লাগবে। জুজুৎসুর প্যাঁচে প্রতিপক্ষ যেমন নিজের শক্তিতেই ধরাশায়ী হয়, এই প্রতিষ্ঠানগুলির উৎকর্ষের জেরে তাদের নতুন বিড়ম্বনায় ফেলা হচ্ছে।

দেশের শ্রেষ্ঠ ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ বার কিছু বিশেষ স্বাধীনতা দেওয়া হবে: নিজস্ব পাঠ্যক্রম বানাতে; অবাধে, বিচার মতো দক্ষিণায় দেশ-বিদেশের শিক্ষক নিয়োগ করতে; নতুন শাখা ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করতে; বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ করতে, ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য স্তরের প্রতিষ্ঠান থেকে তালিকায় আছে একমাত্র যাদবপুর।

সমস্যা হল, সারস্বত স্বাধীনতার কিছু অনুপান লাগে। নতুন কর্মকাণ্ডে সরকার একটা পয়সাও দেবে না, সবটাই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের উদ্যোগে জোগাড় করতে হবে। হায়, শিক্ষার মুক্তি কেবল আলোয় আলোয় ঘাসে ঘাসে নয়; আধুনিক পঠনপাঠন-গবেষণা ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। হয়তো সেটা বুঝে প্রথম দিকে যেন কাকতালীয় ভাবে কিছু টাকার প্রতিশ্রুতি আসছে। তার একটা সূত্র রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান (রুসা), যা রাজ্য থেকে পরিপূরক অর্থ দাবি করে। রাজ্য সরকারও ইদানীং যাদবপুর-সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতি দরাজ হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রের আর একটি বিতর্কিত প্রকল্পে শীঘ্রই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান’ (ইনস্টিটিউট অব এমিনেন্স) হিসাবে আরও প্রচুর অর্থলাভ করবে; প্রতিযোগীর তালিকায় আছে যাদবপুর ও কলকাতা।

এই বরাদ্দের ফলে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে একটা পথে ঠেলে দেওয়া হবে, যেখানে ভবিষ্যতে তাদের স্থায়ী ভাবে নিজেদের উদ্যোগে প্রচুর অর্থের সংস্থান করতে হবে। তার একটা উপায় ছাত্রদের বেতন বাড়ানো। বর্তমান বেতনের অঙ্ক (বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে) প্রায়শই নিতান্ত কম, পাঁচ টাকা বাড়াতে চাইলেও বাদ সাধে অবুঝ আন্দোলন; কিন্তু উচ্চ শিক্ষার পুরো খরচ মেটাতে যতটা বাড়ানো দরকার, গরিব ছাত্রকে নির্বাসিত করে, মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করেও তার সংস্থান হবে না। আর এক উপায় বিদেশি ছাত্রদের আকৃষ্ট করে তাদের কাছ থেকে যথেষ্ট বেশি বেতন নেওয়া। আর এক হল, শিল্প-বাণিজ্যের সহায়ক হয়ে সরাসরি অর্থ উপার্জন করা। সে ক্ষেত্রে যে যে বিষয় শিল্প-বাণিজ্যের পক্ষে প্রাসঙ্গিক, সেগুলিই প্রাধান্য পাবে, বাকিগুলি হবে ক্ষয়িষ্ণু (এমনিতেই এই প্রবণতা দেশ জুড়ে প্রবল, পশ্চিমবঙ্গ বরং খানিক ব্যতিক্রম)। আরও এক উপায়, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তাদের পরিকাঠামোর সুযোগ নেওয়া, তাদের সহযোগে হয়তো তৃতীয় কোনও দেশে শাখা বা উপকেন্দ্র গড়া।

প্রশ্ন তোলাই যায়, এত করে লাভ হবে কি? দিল্লির শিক্ষকরা পুরো প্রকল্পটার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। যাদবপুরের প্রতিক্রিয়া বরং সন্দিগ্ধ হলেও সংযত ও কিছুটা ইতিবাচক। সোজা কথা, ব্যাপারটা শিক্ষাসমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেক জরুরি নীতি ও চাহিদাকে অগ্রাহ্য করে। অথচ প্রত্যাখ্যান করলে আর কোনও সুযোগের আশু সম্ভাবনা ক্ষীণ; উপরন্তু প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর কমবে, সমাজের চোখে সেটি হেয় হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের অভিপ্রায় যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজ্যের কর্তব্য, প্রতিশ্রুত স্বাধীনতা ঠান্ডা মাথায় প্রয়োগ করে নিজের মতো কিছু গড়ে তোলা।

অতএব ভাবতে হয়, রাজ্যে উচ্চ শিক্ষার কী দশা, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়েরই বা কী অবস্থা। এই বার সেই প্রশ্নই তুলব।

পশ্চিমবঙ্গের হাল

সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করি। গত ছ’সাত বছরে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চ শিক্ষার হাল ভাল না খারাপ হয়েছে? লেখাপড়া-গবেষণার সাধারণ ভাবে উন্নতি ঘটেছে কি? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষার ফল কী বার্তা দেয়? অগ্রণী প্রতিষ্ঠানগুলির উৎকর্ষ কি অক্ষুণ্ণ আছে? নতুনগুলি কি সংখ্যা ছাড়া অন্য বিচারে নজর কেড়েছে? যে ঐতিহাসিক বিদ্যায়তনটি নতুন অবতারে আবির্ভূত, তা কি বিদ্যাচর্চার কোনও নতুন দিশা দেখিয়েছে?

এ দিকে কলেজে কলেজে ভর্তি নিয়ে অভিযোগ অভূতপূর্ব মাত্রা ছাড়িয়েছে। হানাহানির প্রকোপ বেড়েছে বই কমেনি। শিক্ষা থেকে রাজনীতি হটাবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পরিহাসে পর্যবসিত হয়েছে।

আগের জমানার রাজনীতিকরণ যথেষ্ট ক্ষতিকর ও নীতিভ্রষ্ট ছিল, কিন্তু তা সাংগঠনিক স্তর ছাড়িয়ে সাংবিধানিক পর্যায়ে পৌঁছয়নি। ফলে রাজনৈতিক কার্যকলাপের এক পাশে, বা কদাচিৎ বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহে, লেখাপড়া-গবেষণা চলেছে এমনকী বেড়েছে। রাজ্যের যে বিদ্যাকেন্দ্রগুলি আজও দেশে-বিদেশে উচ্চ স্বীকৃতি পায়, তাদের সাম্প্রতিক সাফল্য তখন থেকেই শুরু। বার বার আইন পাল্টে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারের অধীনে আনা, সেই আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বছরের পর বছর সেগুলি স্ট্যাটিউটহীন অবস্থায় ফেলে রাখা, আইনের বাড়া ক্ষমতাবলে উপাচার্যদের উপর প্রভুত্ব কায়েম করা, এ সব বিপ্লব ঘটেছে গত ক’বছরে।

যতই রাজনৈতিক দূরত্ব থাক, উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে কেন্দ্র আর রাজ্যের বর্তমান শাসকদের মনোভাব এক। উভয়ই শিক্ষকসমাজের প্রতি প্রতিপক্ষীয় অবস্থান নিয়েছে— অনাস্থা, প্রায় অবজ্ঞা, অতএব খবরদারি, চোখরাঙানি, এবং উচ্চ শিক্ষার ‘উচ্চতর’ দিক অর্থাৎ গবেষণা ও উদ্ভাবন সম্বন্ধে অনীহা। গবেষণা নিয়ে সরকারমাত্রেই নিরুৎসাহ, কিন্তু আগে কখনও শিক্ষকদের এত আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধার চেষ্টা হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, কলেজগুলিতেও অনেক ইচ্ছুক শিক্ষক এক রকম করে গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন। তাই আর এক অংশের স্থবিরত্ব ও তৃতীয় এক অংশের টিউশনস্পৃহা সত্ত্বেও বাংলা সেই বিরল রাজ্যের অন্যতম, যেখানে গবেষণার ধারাটা সজীব ছিল ও কিছু মাত্রায় এখনও আছে। শুধু কলকাতা-যাদবপুর নয়, অন্য একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন সূত্রে (বিশেষত কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক থেকে) এ জন্য স্বীকৃতি পেয়েছে।

এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল শিক্ষা দফতর চিন্তা করবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বটেই, কলেজে কলেজে পঠনপাঠন চালু রেখে শিক্ষকদের, বিশেষত তরুণ শিক্ষকদের, কী ভাবে সাধ্য মতো গবেষণার সুযোগ দেওয়া যায়। তার জন্য দরকার অবকাশ ও স্বাধীন বিচরণ। স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার যাচাই হবে গবেষণার মূল্যায়ন করে ও ভাল কাজ পুরস্কৃত করে, ছুটি আটকে হাজিরাযন্ত্র বসিয়ে নয়। এই যন্ত্রশাসনে স্টাফরুমে আরামের অবকাশ পূর্ববৎ থাকবে, রমরমিয়ে চলবে টিউশনের সান্ধ্য বাজার; মিলিয়ে যাবে উপযুক্ত গ্রন্থাগার-গবেষণাগারে বিদ্যাচর্চার সুযোগ, কারণ তার রসদ প্রায় কোনও শিক্ষকই তাঁর নিজের কলেজে পাবেন না। শিক্ষকদের কোন অংশকে শিক্ষাকর্তারা সম্মান ও উৎসাহ দিতে চান?

কেন্দ্রের যেমন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য সরকারের তেমনই যাদবপুরের প্রতি বিশেষ বিরূপতা প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৪-র সার্বিক আক্রমণে, পুলিশের হাতে ছাত্রনিগ্রহ যার প্রতীক বা রূপকমাত্র। সম্মিলিত প্রতিরোধে বিপর্যয় ঠেকানো গিয়েছিল; কিন্তু যাদবপুরের প্রাঙ্গণ আজও অভ্যস্ত ছন্দে ফেরেনি। ছাত্র-শিক্ষক-প্রশাসকের সবচেয়ে উৎসাহী ও সক্রিয় অংশের মনোবলে ভাটা পড়েছে। আর সেই বিপুল আলোড়নের উত্তরাধিকার স্বরূপ যে কোনও মাপের যে কোনও উপলক্ষে শিক্ষাপ্রাঙ্গণ বার বার উত্তপ্ত হচ্ছে, স্তব্ধ হচ্ছে কাজের গতি। ভবনগুলি, এমনকী মূল প্রশাসনিক ভবন লজ্জাকর ভাবে বিধ্বস্ত, যখন আন্দোলন নেই
তখনও অশান্তির স্বাক্ষর বহন করছে। এটা সারস্বতচর্চার উপযুক্ত আবহ বলে অন্যান্য অগ্রণী প্রতিষ্ঠানের মানতে বাধবে। ইতিমধ্যেই তেমন বার্তার আভাস মিলছে।

যাদবপুরের স্থায়ী অর্থবল সামান্য। তার সাফল্যের মূলে আছে নানা সূত্র, যেমন— সরকারি মন্ত্রক, অর্থসংস্থা, শিল্পসংস্থা, দেশ-বিদেশের অসংখ্য বিদ্যায়তন ও গবেষণাকেন্দ্রের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে জ্ঞানের আদানপ্রদান করা, অর্থের সংস্থান করা, সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করা। পৃথিবী জুড়ে এই যোগসূত্র এক বার ছিন্ন হলে পুরো প্রক্রিয়াটা থমকে যাবে, ধসে যাবে কর্মকাণ্ডের ভিত।

হতে পারে অনেকের মতে হালের প্রতিটি আন্দোলন এত জরুরি, তার অনুসৃত পদ্ধতিও এত অপরিহার্য, যে বিনিময়ে বড় মাপের সারস্বত ক্ষতিও সই। কিন্তু ক্ষতিটা যে অবধারিত, তা জেনেবুঝে মানতে হবে, তর্ক জুড়ে বা ফের আন্দোলন করে রোখা যাবে না। অনেক আশা নিয়ে যে মেধাবী ছাত্র-গবেষকরা এখানে জড়ো হন, যে তরুণ শিক্ষকরা আজও অন্য লোভনীয় সুযোগ ছেড়ে পড়াতে আসেন, এতটা ক্ষতি স্বীকারে তাঁরা রাজি তো? রাজি হবেন রাজ্যের জনগণ? বিপত্তির মূলে অবশ্যই ২০১৪-এ শাসককুলের হঠকারিতা; তার পরও নানা প্ররোচনা ঘটেছে। কিন্তু জেএনইউ-এর মতো এ ক্ষেত্রেও লোকচক্ষে বিপর্যয়ের দায় পড়বে আন্দোলনকারী তথা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্প্রদায়ের উপর, আগের ইতিহাস কেউ ঘাঁটবে না।

জেএনইউ-এর সঙ্গে একটা তফাতও আছে। পূর্ব অবস্থান থেকে কিছুটা সরে, রাজ্য সরকার ইদানীং যাদবপুরের প্রতি খানিক ইতিবাচক অবস্থান নিচ্ছে। সাধারণ ভাবে সারস্বত উন্নয়ন নিয়ে এক-আধটু উচ্চবাচ্য হচ্ছে, রাজ্য স্তরে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণা ভবনের কথা শোনা যাচ্ছে। যাদবপুরের সামনে নতুন সম্ভাবনাগুলো তাই বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। এটা কেবল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের প্রশ্ন নয়, বাষট্টিটারও নয়। এগুলিতে কোনও উন্নয়ন সাধিত হলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে তার বিস্তার ঘটতে বাধ্য, পরিকল্পনা করে বিশেষ ভাবেই ঘটানো যায়।

এ বার তাই সনির্বন্ধ আবেদন: কর্তৃপক্ষ শিক্ষাব্যবস্থাকে শিক্ষাসমাজের হাত থেকে বাঁচাবার আত্মঘাতী প্রয়াস ত্যাগ করুন। নতুন কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের মূল কথা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা, যে অর্থেই হোক; তার সদ্ব্যবহার শিক্ষকদের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে। শিক্ষণেচ্ছুদেরও বুঝতে হবে, বিরোধ ও বিতর্কের অশেষ নৈতিক যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু যেনতেন প্রতিবাদসর্বস্বতা সমাজ ভাল চোখে দেখে না। গঠনমূলক অনুষঙ্গের অভাবে বিরোধ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।

কয়েক বছর উচ্চ শিক্ষা মহলে বলতে গেলে কোনও খোশখবর শোনা যায়নি, না রাজ্য না কেন্দ্রের সূত্রে। বর্তমান প্রস্তাবগুচ্ছ নিয়ে যতই দ্বিধা থাক, রাষ্ট্রের অভিপ্রায় যা-ই হোক না কেন, তার মধ্যে একটা সদর্থক পরিবর্তনের সম্ভাবনা খোঁজা সারস্বত সমাজের কর্তব্য। তাকে ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দিলে সেই সমাজের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, গুণাগুণ নিয়েও। বিদ্যাচর্চা ও সমাজকল্যাণের অপরিহার্য নীতির সঙ্গে প্রস্তাবগুলির সমন্বয় ঘটানোর উপায় খোঁজাই শুভবুদ্ধি। বহু দিনের হতাশা থেকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা ফেলে দেওয়ার নয়। দিলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য যে ভবিষ্যৎ গড়া, সেই ভবিষ্যতের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Protest Rally Higher education State Responsibility
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE