Advertisement
E-Paper

ধস-সমস্যা মিটবে কী ভাবে

স্থানীয় মানুষজনের অভিজ্ঞতা বলে ‘ইসিএল’-এর আমলে কয়লাখনন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এলেও বাস্তবে সমস্যা কমেনি, বরং দিনে দিনে বেড়েছে। তাই এই এলাকায় আজ ধসের মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। স্থানীয় মানুষজনের অভিজ্ঞতা বলে ‘ইসিএল’-এর আমলে কয়লাখনন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এলেও বাস্তবে সমস্যা কমেনি, বরং দিনে দিনে বেড়েছে।

মিলন চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪৯
আসানসোলে ধস। ফাইল ছবি

আসানসোলে ধস। ফাইল ছবি

১৮৫৫ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে দামোদর নদের পাশে প্রথম কয়লাখনির জন্য খনন শুরু হয়। তার পরে এই অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে প্রবল হারে কয়লা উত্তোলনের কাজ চলে অন্তত একশো বছর। এই সময় কয়লাখনি থেকে যে পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হত, তা কতটা ‘বিজ্ঞানসম্মত’ ছিল সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন। প্রায় একশো কুড়ি বছর বাদে কয়লাখনি জাতীয়করণের কাজ শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে কয়লাখনি জাতীয়করণের পরে, ১৯৭৫ সাল থেকে এই অঞ্চলের কয়লা তোলার দায়িত্ব নেয় ‘ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেড’ বা ‘ইসিএল’।

‘ইসিএল’-এর মতো একটি সংস্থা কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব পাওয়ার পরে, অনেকেই আশা করেছিলেন যে এ বার হয়তো এই অঞ্চলে অবৈজ্ঞানিক ভাবে কয়লা খনন বন্ধ হবে এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তাও সুনিশ্চিত হবে। কিন্তু স্থানীয় মানুষজনের অভিজ্ঞতা বলে ‘ইসিএল’-এর আমলে কয়লাখনন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এলেও বাস্তবে সমস্যা কমেনি, বরং দিনে দিনে বেড়েছে। তাই এই এলাকায় আজ ধসের মতো ঘটনা বারবার ঘটছে। এই এলাকায় ধস বা কয়লানিতে আগুনের মতো যে ঘটনাগুলি অনবরত ঘটে চলেছে, তা অনাগত ভবিষ্যতের পক্ষে অশনিসঙ্কেত।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন ‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি’। এই কথাটা পশ্চিম বর্ধমান জেলার অণ্ডাল, রানিগঞ্জ, আসানসোল এলাকার মানুষদের ক্ষেত্রে সর্বার্থে প্রযোজ্য। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা ‘বাঘ’ নয়, প্রতিদিন লড়াই করে চলেছেন মৃত্যুর সঙ্গে। ইসিএলের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, অণ্ডাল ব্লক থেকে শুরু করে সালানপুর-চিত্তরঞ্জন পর্যন্ত পশ্চিম বর্ধমানের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রয়েছে ৭৪টি খোলামুখ কয়লাখনি। এই সমস্ত কয়লাখনি থেকে ফি-দিন হাজার হাজার টন কয়লা তোলা হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, কয়লা ফুরিয়ে গেলেও সে সব খনি ভরাটের যথাযথ ব্যবস্থা করা হয় না। যদিও আইন অনুসারে, এই সমস্ত খোলামুখ খনি ভরাটের দায়িত্ব ‘ইসিএল’ কর্তৃপক্ষের।

‘ইসিএল’ খোলামুখ খনি থেকে প্রচুর পরিমাণে কয়লা তোলার পরেও সেই সমস্ত খনিতে খানিকটা কয়লা থেকে যায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা অংশের অভিযোগ, সেই কয়লা তোলার জন্য ‘ইসিএল’-এর কিছু আধিকারিক, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু আধিকারিক এবং কিছু রাজনৈতিক নেতার মদতে নেমে পড়ে কয়লা মাফিয়ার দল। এই অঞ্চল থেকে কয়লা তুলে বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ ভাবে পাচার করা হয় দিনের পর দিন। এই সব খোলামুখ খনি থেকে প্রতি মুহূর্তে বিপদ ঘনিয়ে আসে স্থানীয় মানুষজনের জীবনে। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই সমস্ত পরিত্যক্ত খোলামুখ খনিতে হঠাৎ করে আগুন জ্বলে ওঠে। সে আগুন যে কবে এবং কী ভাবে নিভবে, জানেন না কেউ। সেই জ্বলন্ত আগুনের ছাইয়ে আকাশ ঢাকে। পায়ের তলার মাটি আচমকা ধসে সেই আগুনে পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

শুধু আগুন নয়, যে কোনও সময় এই সমস্ত অঞ্চলে দেখা দেয় ধস। কারণ, এই অঞ্চলগুলি গোটাটাই প্রায় ফোঁপরা। কয়লা তুলে বালি দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার নিয়ম থাকলেও, অনেকেই অভিযোগ করেন সে কাজ করা হয় দায়সারা ভাবে। কাগজেকলমে অবশ্য দেখানো হয় যে বালি দিয়ে ভরাট বা খনিমুখ বন্ধ করা সবই হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে যে পরিমাণ বালির দরকার হয়, তা দেওয়া হয় না। থেকে যায় ফাঁক যা দিয়ে ঢুকে পড়ে কয়লাচোরের দল— এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, কিছুদিন আগে কয়লাভর্তি একটি ডাম্পার হঠাৎ করে ধসের মধ্যে পড়ে। ড্রাইভার উপস্থিত বুদ্ধি আর ভাগ্যের জোরে কোনও প্রকারে বেঁচে গেলেও ডাম্পারটি ধসের কারণে বসে যায়। সংবাদমাধ্যমে কিছু দিন আগে সালানপুর এলাকায় বাড়ি বসতে শুরু করার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এমন নানা ঘটনা আকছারই জেলার নানা প্রান্তে ঘটে চলেছে। তার কিছু সামনে আসে, কিছু আসে না।

স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, কয়লাখনি অঞ্চলে এমন অনেক পরিত্যক্ত খোলামুখ খনি রয়েছে যেখানে জল জমে পুকুর হয়ে থাকার দৃশ্য নজরে পড়ে। অনেকেই সেই পুকুরে নেমে তলিয়ে যান। ইসিএলের অধীনস্থ কয়লাখনি অঞ্চলে এমন বিপদ হামেশাই ঘটে চলেছে। রানিগঞ্জ, আসানসোল, অণ্ডালের মানুষদের ধস বা আগুনের আতঙ্ক নিয়ে বাস করাটা যেন এক প্রকার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এক দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘উদাসীনতা’, অন্য দিকে বেআইনি কয়লা কারবারের বাড়বাড়ন্তের কারণে আজ লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ এক ভয়ঙ্কর পরিণতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।

কয়লা মাফিয়ারা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভাবে মাটি কেটে কয়লা তুলে চলেছে। এর জেরে ভূগর্ভ ক্রমশ শূন্য হচ্ছে। ফলে, এই সব এলাকায় আজ এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কোনও সময় ঘটে যেতে পারে বড় দুর্ঘটনা। কিন্তু প্রশাসন বা ইসিএল কর্তৃপক্ষ কারও কোনও হেলদোল নেই বলে অনেকেরই অভিযোগ। ভোট এলে রাজনৈতিক নেতারা ধসের ঘটনাকে ভোট-প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় না কিছুই। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের ক্ষোভ, ভোটের আগে যাঁরা খনির আগুন বা ধস-সমস্যা নিয়ে পাশে থাকার কথা বলেন, দুর্ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের দেখা মেলে না। হয় না সমস্যার সমাধানও।

লেখক দুর্গাপুরের সংস্কৃতিকর্মী

Landslide ECL Coal Mining Burdwan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy