Advertisement
E-Paper

ইতিহাস-কানা দেশের মানুষ যখন আবেগের স্রোতে গা ভাসান

১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে রোয়ান্ডায় টুটসি এবং হুটু জনজাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ১০ লক্ষ মানুষ। যাঁদের প্রায় সকলেই টুটসি। বলা হয়, ‘আরশোলা’র মতো বেছে বেছে মারা হয়েছিল টুটসিদের। আর পৃথিবী দেখেছিল, লক্ষ লক্ষ টুটসি রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে আশ্রয় খুঁজছেন কঙ্গো সীমান্তে।

স্যমন্তক ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ইতিহাস মনে রাখার সত্যিই কি খুব প্রয়োজন আছে? বিশেষত তা যখন হিংসার, বিদ্বেষের, যুদ্ধের, গণহত্যার? — ‘ব্ল্যাক আর্থ রাইজ়িং’। হুগো ব্লিক পরিচালিত টেলি-সিরিজ়টির মূল বিষয়বস্তু ঘুরতে থাকে ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে। ‘রোয়ান্ডা গণহত্যা’র পরবর্তী সময়ের এই সিরিজ়টি নিয়ে বেশ আলোচনাও হচ্ছে চারিদিকে।

১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে রোয়ান্ডায় টুটসি এবং হুটু জনজাতির মধ্যে গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ১০ লক্ষ মানুষ। যাঁদের প্রায় সকলেই টুটসি। বলা হয়, ‘আরশোলা’র মতো বেছে বেছে মারা হয়েছিল টুটসিদের। আর পৃথিবী দেখেছিল, লক্ষ লক্ষ টুটসি রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে আশ্রয় খুঁজছেন কঙ্গো সীমান্তে। এর কিছু দিনের মধ্যেই টুটসিদের জঙ্গি গোষ্ঠী পাল্টা আঘাত হানে হুটুদের উপর। এ বার উদ্বাস্তু হন অন্তত ২০ লক্ষ হুটু মানুষ। বিশ্ব কূটনীতির আবহ সে সময় ‘রোয়ান্ডা গণহত্যা’ নিয়ে কম মাথা ঘামায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জ তো বটেই, আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিভিন্ন দেশ হস্তক্ষেপ করেছিল উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। এবং শেষে তথাকথিত শান্তি ফেরে রোয়ান্ডায়। তৈরি হয় স্বাধীন সরকার।

‘ব্ল্যাক আর্থ রাইজ়িং’ ছবির প্রেক্ষাপট শুরু হয় সেখান থেকেই। একদা আক্রান্ত, পরিবার বিচ্ছিন্ন টুটসি-কন্যা এখন প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতায় এসে নিয়ম জারি করেছেন, গণহত্যার ইতিহাস পড়ানোর দরকার নেই। তা নিয়ে আলোচনা করলেও শাস্তি পেতে হবে। দেশের কালো অধ্যায় মুছে ফেলতে হবে মানুষের স্মৃতি থেকে। গণহত্যার নথি যাঁদের হাতে আছে, তাঁদেরও দেশে ঢোকা কার্যত নিষিদ্ধ হয়। হামলা হয় বিদেশের মাটিতে। কিন্তু ইতিহাসকে এ ভাবে চেপে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? কাহিনি উপসংহারে পৌঁছয়— সম্ভব নয়। ইতিহাসকে চেপে রাখলে হিংসার জমি মজবুত হয়। আগাপাছতলা না জেনে তাৎক্ষণিক ঘটনাকেই মানুষ তখন ইতিহাস বলে ধরে নিতে শুরু করেন। শুরু হয় তথ্যের বিকৃতি। যা হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার। ইতিহাস ক্রমশ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘প্রোপাগান্ডা’। ছবিটিতে এ সব কথাই বলার চেষ্টা হয়েছে। ইতিহাস, তা যত অন্ধকারই হোক, ভবিষ্যৎকে তার থেকেই পাঠ নিতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। আজকের ভারতীয় উপমহাদেশে কথাগুলো বড্ড জ্যান্ত মনে হচ্ছে।

কাশ্মীর তো দূরের বিষয়, দেশের উত্তর-পূর্বে অসম মেঘালয় মণিপুর নাগাল্যান্ড মিজোরাম ত্রিপুরা, এমনকি সিকিমের ইতিহাস বিষয়েও কতটা ধারণা আছে আমাদের? অথবা প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান? পূর্ববঙ্গের ইতিহাস সম্পর্কে আদৌ কতটা জানি আমরা বাঙালিরা? ‘জাতীয়তাবাদী’ দেশ ও তার রাজনীতি ‘অস্বস্তিকর’, ‘প্রান্তিক’ ইতিহাস জানতে দেয় না। সেটুকুই বলা হয়, যেটুকু গরিমার, এবং মূলস্রোতের। সে জন্যই কাশ্মীর সমস্যার উৎস, জটিলতা কিচ্ছু না জানিয়ে ছোটবেলা থেকে শাসকের ‘ন্যারেটিভ’ কেবল একটি কথাই পাখিপড়ার মতো শিখিয়ে দেয়: ‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’। কথাটি বলার মধ্যেই যে একটা আস্ফালন লুকিয়ে আছে, সে প্রশ্নও তুলতে বারণ করেছে রাষ্ট্র। জিগ্যেস করা যাবে না, ‘আফস্পা’ কী? কেন সেই আইন পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান কিংবা পঞ্জাবে নেই কিন্তু কাশ্মীরে আছে। কেন সেই আইনের বলে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে জলপাই পোশাকের বাড়বাড়ন্ত। আজ যাঁরা কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিল করার জন্য গলা ফাটাচ্ছেন, তাঁরা জানেন তো ঠিক কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে কাশ্মীরের জন্য এই বিশেষ ধারা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল রাষ্ট্র?

জাতিকে যখন এ ভাবে ইতিহাস-কানা করে রাখা হয়, রাষ্ট্রশক্তি তখন খুব সহজে ঘটমান বর্তমানকেই একমাত্র সত্য বলে প্রতিপন্ন করে মানুষের ভাবাবেগে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। অতীতে কখনও কখনও এমন ঘটেছে। দেশের বর্তমান শাসকও ঠিক সেই কাজটিই করছে। মানুষকে তারা বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, কাশ্মীর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল কেবলই একটি জঙ্গি ঘাঁটি। ফলে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও সেখানকার মানুষ নন। কাশ্মীরি মাত্রেই উগ্রপন্থী। ফলে তাঁদের মুখে পেলেট ছোড়া অন্যায় নয়। তাঁদের হত্যা করায় ভুল নেই। সেনার গাড়ির সামনে কাশ্মীরি নাগরিককে বেঁধে রেখে শহর ঘোরানো অপরিহার্য কূটনীতি। জেনিভা কনভেনশন তখন নেহাতই অবান্তর। এ সব বলতে বলতে কখনও কখনও কাশ্মীরিদের কার্যত পাকিস্তানি বলেও দেগে দেওয়া হয়। আর কে না জানে, নয়া-জাতীয়তাবাদী ভাষ্যে পাকিস্তানি মাত্রেই জঙ্গি!

মহান ভারত কথায় কথায় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে কষ্টিপাথরের মর্যাদা দেয়। এমনকি, বর্তমান শাসকও (যদিও তাদের শাখাপ্রশাখা একাধারে নাথুরাম গডসেকে ঈশ্বরের আসনে বসান)। কিন্তু শাসক ভুল করেও বলে না, কাশ্মীরে গণভোট চেয়েছিলেন গাঁধী। জানতে চেয়েছিলেন কাশ্মীরের মানুষের ইচ্ছা। বলা হয় না, দেশ টুকরো হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে কাশ্মীরে দু’দেশের আগ্রাসী মনোভাব দেখে ঠিক কী রেজ়লিউশন নিয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ! কেন ৭০ বছর ধরে সেই রেজ়লিউশনের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারল না দু’দেশের সরকার!

ভাবাবেগে ভাসা অন্যায় নয়। মন থেকে আবেগ যখন হারিয়ে যায়, তখন কেবল একটি রোবট পড়ে থাকে। জাতীয় পতাকায় মোড়া থরে থরে সাজানো পুলওয়ামার নিহত জওয়ানদের কফিন দেখলে আঘাত লাগে। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা রক্তের স্রোত বয়ে যায়। কিন্তু একই রকম শিহরন হয় এক মুখ রক্তে ভাসা পেলেটাহত কাশ্মীরি শৈশবের ছবি দেখলে। আজ যাঁরা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক দেশাত্মবোধে ভাসিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৮ সালের জুন মাসের রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত রিপোর্টে কাশ্মীরের বর্ণনা তাঁরা পড়েছিলেন তো? সেই রিপোর্টে সামগ্রিক ভাবে কাশ্মীরের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা লেখা হয়েছে। যার একাংশ ভারতে, অন্য অংশ পাকিস্তানের আওতায়। কাশ্মীরে প্রতিনিয়ত কী ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে, তার বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে রিপোর্টটিতে। রিপোর্টে প্রস্তাবনার আকারে লেখা হয়েছে, ‘‘কাশ্মীরের মানুষের উপর চক্রাকারে যে হিংসা ঘটে চলেছে, এই মুহূর্তে তা বন্ধ করার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। আলোচনার টেবিলে বসতেই হবে সব পক্ষকে।’’ শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট বলছে, গত কয়েক দশকে কয়েক লক্ষ সাধারণ কাশ্মীরিকে হত্যা করেছে রাষ্ট্রশক্তি। লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনও নিখোঁজ। গ্রামের পর গ্রাম, কাশ্মীরি মহিলারা নিজেদের পরিচয় দেন ‘হাফ উইডো’ বা ‘অর্ধ বিধবা’ বলে। কারণ, তাঁরা জানেন না, সত্যিই তাঁদের স্বামীর মৃত্যু হয়েছে কি না। জন্নত নয়, ভূস্বর্গের আর এক নাম এখন ট্রমা।

জাতীয়তাবাদের যে পাঠ থেকে ভারতীয় জওয়ানদের মৃতদেহ দেখে আমাদের ভাবাবেগে আঘাত লাগে, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হয়, দশকের পর দশক ধরে একই রকম প্রতিক্রিয়া হয় আমাদেরই মতো রক্তমাংসে গড়া অগণিত কাশ্মীরির। ভারত-পাকিস্তানের মূলস্রোতের রাজনীতি যেমন আমাদের ভাবাবেগকে ব্যবহার করে, কাশ্মীরের মানুষের ভাবাবেগকে সে ভাবেই ব্যবহার করে অসংখ্য জঙ্গি গোষ্ঠী। আবেগ উগ্র হয়। আগুন জ্বলে। ভিটে ছাড়তে হয় পণ্ডিতদের। রাজনীতি তাঁদেরও ব্যবহার করে।

এ কথা সত্য, উপমহাদেশে অশান্তি জিইয়ে রাখার জন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে পাকিস্তান ব্যবহার করে। দেশের মাটিতে তারা জঙ্গি ক্যাম্প চলতে দেয়। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে এ সব বিষয়ে বহু আলোচনা হয়েছে এবং হবে। আবার পাকিস্তানও সময় সময় অভিযোগ তোলে, বালুচিস্তানে অশান্তি জারি রাখার জন্য মদত দেয় ভারত।

কে কাকে কী ভাবে মদত দিচ্ছে, সে আলোচনা কূটনীতির। রাজনীতি এবং কূটনীতি ভাবাবেগে চলে না। প্রয়োজন মতো ভাবাবেগ ব্যবহার করে কেবল। এই মুহূর্তে ঠিক সে ঘটনাই ঘটছে। ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তার কূটনৈতিক বিশ্লেষণ আমাদের কাজ নয়। কিন্তু সামান্য ইতিহাসবোধ থাকলে এটুকু বোঝা যায়, একটি বা দু’টি জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করে আর যা-ই হোক, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয় না। ‘মায়ের কোল খালি করে দেব’ হুমকি পৃথিবীর কোথাও আগুন নেভাতে পারেনি। তার জন্য নিরন্তর আলোচনা প্রয়োজন। গত ৭০ বছর ধরে সে কাজটিতেই রাজি হয়নি দু’দেশের রাজনীতি। কারণ, আলোচনার টেবিলে বসলে ‘অস্বস্তি’র ইতিহাস মান্যতা পেয়ে যায়। ইগো জলাঞ্জলি দিতে হয়। দেশের মানুষকে বলে দিতে হয় অনেক কথা, যা এখনও ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে।

অতএব, ভাবাবেগকে ব্যবহার করে তাৎক্ষণিক সাফল্যের উদ্‌যাপন। ইতিহাস-কানা দেশের মানুষ যদি সেই উন্মাদনায় গা ভাসাতে চান, ভাসান। কিন্তু তাঁরা যদি ভেবে থাকেন, এর ফলে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে, তা হলে তাঁরা কেবল ভুলই ভাবছেন না, মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।

তাওয়া গরমই ছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদ কাশ্মীরের মানুষকে আরও দূরে ঠেলে দিল। আরও জটিল হল সমস্যা। ইতিহাসের খাতায় সে কথাও নথিবদ্ধ হবে। কিন্তু সরকার তার দায়িত্ব নেবে তো?

Indian Army Kashmir History
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy