Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মৃত্যুও যখন কেবল বিনোদন

খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে থাকার সময়েও তিনি ব্যক্তিগত জীবনের কারণে কুৎসিত গালাগালি, মারধর, সামাজিক বয়কটের মুখোমুখি হয়েছেন। নতুন করে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করার পরও মৃত্যুবেলায় তাঁকে আবার গুজব-নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত হতে হল।

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

অভিনেত্রীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে রসালাপের অধিকার তো আমজনতার থেকেই যায়। বিশষত যখন তাঁর কর্মস্থল দেশের বিনোদন জগতের প্রধান বিন্দু বলিউড! তাঁর দ্যুতিময় রিল জীবনের সর্বোচ্চ খ্যাতির সময়ে অবশ্যই দৈনন্দিন খুঁটিনাটি এ ভাবে তথ্য, প্রমাণ, ছবি নিয়ে আজকের মতো তৎক্ষণাৎ হাজির হতে পারত না। তাঁরা সে সময় ছিলেন ধরাছোঁওয়ার বাইরে দূর গগনের তারা। বাঙালি নায়কের সঙ্গে মাড আইল্যান্ডের কাচমোড়া ঘরের দ্বৈত বাসরের খবর উড়ে উড়ে আসত, আবার প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ হয়ে মিলিয়ে যেত।

দিনকাল আর আগের মতো রহস্যচাপা নেই। এখন সুলভ শৌচাগারে বসেও সরাসরি অমিতাভ বচ্চনকে জ্ঞান দেওয়া যায়। যে কারও সম্পর্কে নির্বিচারে মন্তব্যের পর মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া যায়। বলা যায়, হুইটনি হিউস্টনের মতো বাথটবে ডুবে মৃত্যু যখন, দু’জনের শরীরেই মাদক বা অ্যালকোহলের সমাপতন যখন, রহস্য কাহিনির জাল তো আছেই। খিড়কি পুকুরে, নিদেনপক্ষে কলের তলায় না গিয়ে বাথটবে ডুবে স্নান করাটা যথাযথ ভারতীয় পদ্ধতি হল কি? স্নানঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধই বা ছিল কেন? বিশেষত দরজার ও-পারে যখন স্বামী ছাড়া কেউ নেই! পাকিস্তানি সহ-অভিনেতা নাকি অভিনেত্রীর স্বামীকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছেন। তিনি তো সম্ভাব্য সন্দেহভাজন হতেই পারেন! কেউ ছবি এঁকে বাথরুমের দরজা আর বাথটবের দূরত্ব মাপলেন, কেউ আবার ক্যামেরার সামনে উৎসাহে টইটম্বুর হয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণে লাফ মেরে গোলাপি বাথটবে শুয়ে পড়লেন।

আদরের বড় মেয়ে আসেননি কেন? প্রথম ছবির প্রোমোশন ছিল ঠিকই, কিন্তু বেশ ক’টা ভিডিয়োয় দেখলাম না, জাহ্নবীকে ফটোশুটে মা শাসন করছেন? — দুবাই পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে অনেক সময় নিয়েছে, বোঝাই যায় ব্যাপার কত অস্বাভাবিক। দুবাই পুলিশ বলছে মৃত্যুর কারণে কোনও ধোঁয়াশা নেই! তা বলবেই তো! সর্বঘটের দাউদ ও বাথটব দুই-ই মজুত যেখানে, রহস্য নিশ্চয় ঘন, সে আবার বলার কী!

চব্বিশ বার অপারেশন করিয়েছেন তিনি, নিখুঁত ভাবে বয়স ধরে রাখার জন্য। তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কতখানি, সে কি আর কারও অজানা? হৃদরোগ আর প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যা-ই বলুন, ও-সব শুনতে বয়েই গেছে দেশজোড়া সমালোচকদের।

কোন আত্ম-অবিশ্বাসে আস্থাহীনতায় নিজেকেই কাটাকুটি করে গেলেন সারা জীবন, পুরুষের দৃষ্টিতে নিজেকে মোহময়ী করতে গিয়ে শরীর-স্বাস্থ্য তুচ্ছ করে দিলেন, সেই অপরিণতমনস্কতা নিয়েও বিস্তর টানাহ্যাঁচড়া পাওয়া গেল অত্যুৎসাহী কিছু সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে! মিডিয়ার এমন আখ্যানভঙ্গিমা দেখে অনায়াসে তাদের নব্য মহাকাব্যের জনক আখ্যা দেওয়া যেতে পারে! সোশ্যাল মিডিয়ায় মনে হল সমালোচনা যেন একটু কম, ভক্তি বেশি। তাঁরা স্মৃতি রোমন্থন করলেন, প্রতিবাদ জানালেন আর আপামর ভক্তজনগণ কাঁদলেন হৃদয় উজাড় করে, যা দিয়েই তাঁরা চিরকাল তারকা-বিচ্ছেদে হৃদয় সংযুক্ত করেন।

দেখেশুনে মনে হয় যেন গ্ল্যাডিয়েটর-এর খেলা, মদোন্মত্ত সিংহ বা ষাঁড়ের মুখোমুখি বেচারি দু’পেয়ে মানুষ। রক্তস্নাত বধ্যভূমির আঁশটে গন্ধ ছাপিয়ে ফুর্তি-উল্লাসের ঢেউ গ্যালারিতে ফুলের মালার মতো দুলছে। ওই হর্ষোল্লাসেই হয়তো লুকিয়ে, হয়তো-বা দূরে, কোথাও কাঁদছে যোদ্ধাটির স্বজন। সে কান্না প্রিয়জন-ব্যথার কান্না, বিশ্লেষণ-আলোচনা-সমালোচনার উপরে সেই ব্যথা। এ ভাবেই ফুর্তির বিকারে আপামর জনগণ বিনোদন খুঁজে ফেরে।

এমন সব ‘অসভ্য’ সংস্কৃতির গল্প নাকি আমরা পেরিয়ে এসেছি। আমরা এখন নাকি ভিড়ের মণ্ড-পাকানো আমোদ ও নৃশংসতাকে কথায় কথায় শূলে চড়াই, ব্যক্তিপরিসর রক্ষার জন্য প্রাণ পণ করি। ঠিকই, এই সংবাদমাধ্যমই কত সময়ে গণতান্ত্রিক বা ব্যক্তিগত পরিসর রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু তাদের হাড়েমজ্জায় বসা খাপ পঞ্চায়েতি রূপটি তারা ভুলে যায়নি। খাপ পঞ্চায়েতই বলুন, আর রোয়াক কালচারই বলুন, গোটা ঘটনায় পুরুষদৃষ্টির লোলুপতা (‘মেল গেজ’) দেখলে শিউরে ওঠার জোগাড়। এই হল আমাদের আধুনিক নাগরিক সমাজের সত্যিকারের চেহারা— মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে যা নারী‘চরিত্র’কে রগরগে বিনোদনের প্রচার ও বিক্রির পসার করে তোলে। তাই জন্যই এক অভিনেত্রীর দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরের তলায় কয়েক দিন ধরে চাপা পড়ে যায় সিরিয়ায় ছিন্নভিন্ন শিশুর লাশ, নীরব-মেহুলদের অসামান্য তছরুপ-লুটপাট, কুশমণ্ডির সর্বহারা মেয়ের গণধর্ষণের পর ক্ষুদ্রান্ত্র বেরিয়ে আসা দেহ।

শ্রীদেবী চিনতেন সমাজটাকে। খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে থাকার সময়েও তিনি ব্যক্তিগত জীবনের কারণে কুৎসিত গালাগালি, মারধর, সামাজিক বয়কটের মুখোমুখি হয়েছেন। নতুন করে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করার পরও মৃত্যুবেলায় তাঁকে আবার গুজব-নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত হতে হল। এই সমাজ খ্যাতি দিতে জানে। মর্যাদা দিতে জানে না।

ডিপিএস, শিলিগুড়ি-র শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE