Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মেয়েরা যখন অপরাধী

এই ঘটনাগুলির সব ক’টিকেই এক গোত্রে ফেলা যাবে না। কোনও ঘটনা ঘটেছে, যখন নির্যাতন সহ্যের সীমা পেরিয়েছে তখন, আবার কোনও খুনের ঘটনা ঘটেছে নিজের স্বার্থসিদ্ধি ঘটাতে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পঁচিশ বছর সংসার করার পর শ্রেয়া চক্রবর্তী খুন করলেন তাঁর তিপ্পান্ন বছরের মদ্যপ, অত্যাচারী স্বামীকে। সহ্যের বাঁধ সেই দিন ভেঙে গেল, যে দিন মদ্যপান করে নৈমিত্তিক অশান্তির পর্বে সেই প্রৌঢ় নিজের একমাত্র ছেলের প্রাণনাশ করতে উদ্যত হলেন। নিহত সন্তানের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর বৃদ্ধা মা কাউকে অভিসম্পাত দেননি, বরং পুত্রবধূকে সমর্থন করেছিলেন। এই ঘটনা গত বছর এপ্রিল মাসের। ২০১৬ সালে হওয়া আরও এক খুনের অপরাধী ধরা পড়ল। ব্যবসায়ী যোগেশ বাট্টাকে খুনের সুপারি দিয়েছিল তাঁর নিজের স্ত্রী। খুনটি করে সেই মহিলার প্রেমিক ওরফে জিমের ইনস্ট্রাকটর। সেপ্টেম্বর মাসেই ছেলে রামচরণকে প্রাণে মারার জন্যে সুপারি দিলেন পঞ্চান্ন বছরের প্রৌঢ়া মা। তাঁর উপর সন্তানের অত্যাচার নাকি যৌন নির্যাতনে গিয়ে ঠেকেছিল। মা ছেলেকে খুন করাচ্ছেন, ভাবলে বিহ্বল হয়ে যেতে হয়।

আসলে মেয়েদের হিংসা বলতে সাধারণত আমরা বুঝি মেয়েদের ওপর হিংসা মানে বাড়ির মেয়ে বা বধূকে নির্যাতন। আর তাই মহিলারা খুন করলে, তা আমাদের ঠিক আত্মস্থ হয় না। না, সর্বক্ষেত্রে নারী অত্যাচারিতা হয়ে পুরুষকে শাস্তি দিতে উদ্যত, এমন সহজ সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। এ বছরই এপ্রিল মাসে আটাশ বছরের মনুয়া তার ছাব্বিশ বছরের প্রেমিক অজিতকে দিয়ে স্বামী অনুপমকে খুন করিয়েছে বলে অভিযোগ। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, স্বামীর শেষ আর্তনাদ সে নাকি টেলিফোনে তারিয়ে তারিয়ে শুনেছে। এই বর্ণনা আমাদের বিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিয়েছে। আর ঠিক তার চার মাসের মধ্যে হাওড়ায় আমরা দেখলাম। পঁয়ত্রিশ বছরের শর্মিষ্ঠা তার আটাশ বছরের প্রেমিককে প্ররোচিত করেছে নিজের স্বামীকে খুন করতে।

শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, সারা ভারতেই মহিলাদের মধ্যে জিঘাংসা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। এই বছরই এপ্রিলে বাইশ বছরের নববধূ তার স্বামীর মাথা পাথর দিয়ে থেঁতলে তাঁকে খুন করেছে, কারণ তিনি নাকি দেখতে ভাল ছিলেন না। অগস্টে মুম্বইতে পঁয়তাল্লিশ বছরের গৃহবধূ অমৃতা তাঁর প্রৌঢ় স্বামীকে গৃহবিবাদের সময় সাত বার ছুরিকাঘাত করে মেরে ফেলেছে। হাত একটুও কাঁপেনি।

এই ঘটনাগুলির সব ক’টিকেই এক গোত্রে ফেলা যাবে না। কোনও ঘটনা ঘটেছে, যখন নির্যাতন সহ্যের সীমা পেরিয়েছে তখন, আবার কোনও খুনের ঘটনা ঘটেছে নিজের স্বার্থসিদ্ধি ঘটাতে। সুতরাং, পুরুষদের মতো মহিলাদের ক্ষেত্রেও দুই ধরনের খুনের উদ্দেশ্যকে আলাদা করে দেখা প্রয়োজন।

কিন্তু আমাদের ভাবনার তো গোড়ায় গলদ। পুরুষ এবং মহিলার হিংস্রতাকে আমরা এক ভাবে দেখতেই শিখিনি। আমরা পুরুষকে এক জন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখি, তার অপরাধ বা হিংস্রতাকে আইনি এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। মেয়েদের ক্ষেত্রে আমরা একটা ‘নারীসুলভ’ কোমলতা এবং পবিত্রতার মাপকাঠি প্রয়োগ করি। আর তাই আমাদের ধারণায়, ‘নিষ্ঠুরতার অধিকার’ও মহিলারা পেতে পারে না। ওটা পুরুষের উত্তরাধিকার। একচেটিয়া। কিছু দিন আগেই হায়দরাবাদের ইঞ্জিনিয়ার রুশি কুমার তার তরুণী স্ত্রী হারিকাকে হত্যা করেছে এই কারণে, যে তিনি এম বি বি এস এন্ট্রান্স পাশ করতে পারেননি। নারী শিক্ষার মহিমা নয়, পারিবারিক ‘ইজ্জত’ একটি ডাক্তার পত্নীর দাবি রেখেছিল। সেই দাবি পূরণ হয়নি। গল্প শেষ। তবে এ সব গল্প কি আজকের? স্ত্রীকে তন্দুরি বানানো, প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছোড়া, যৌনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে নির্ভয়াকে হত্যা করা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, সম্মান-রক্ষার্থে খুন— এমন কত কাহিনিই তো রোজ লেখা হচ্ছে। তাতে নির্যাতিতা নারীর দুঃখে দু’বিন্দু অশ্রুপাত, কয়েকটা আলোচনাসভা, প্রবন্ধ রচনা, বড় জোর একটা-দুটো মোমবাতি মিছিল চলতে পারে। সমাজ ভেঙে পড়ার মতো ভয়াবহ নয় এই সব ঘটনা। কিন্তু মেয়েরা যদি খুন করার সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়, তাদের কামনা-যন্ত্রণা-প্রতিরোধ যদি অস্ত্র ধরে ফেলে, তখন আমাদের মনে হয়, সমাজ বুঝি রসাতলে গেল। খুন বা হিংস্র অপরাধ যখন মহিলারা করে, তখনই সমাজপতিদের মধ্যে ‘গেল গেল’ রব ওঠে। আলোচনাসভা বসে, ‘মহিলাদের এই রকম নৈতিক অধঃপতনের কারণ কী?’ মায়ের জাত বলে কথা!

আসলে একটা জরুরি কথা মনে রাখা দরকার, অপরাধ অপরাধই। যে করে, তার বিচার এবং শাস্তি হওয়া চাই। স্ত্রী-পুরুষের অপরাধ প্রবণতাকেও সমাজ যদি লিঙ্গবৈষম্যের আওতায় এনে ফেলে, সে-ও কি চরম অসভ্যতা নয়? আমাদের বুঝতে হবে, প্রযুক্তি-নির্ভর পৃথিবী ভোগবাদের আফিম খাইয়ে, মানুষের কামনাবাসনা ক্ষোভযন্ত্রণা, সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণহীন করে দিয়ে মনুষ্যত্বকেই মাটি করে দিচ্ছে। আজকের পৃথিবীতে মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সত্যের একটা বিশেষ মাত্রা আছে। আগে মেয়েরা শুধু ঘরের ছিল, এখন ঘর আর বাইরের মাঝখানের দরজা খুলে গিয়েছে। তা দিয়ে আলো আসে বটে, অন্ধকারও কম আসে না। লড়াইটা সেই অন্ধকারের বিরুদ্ধে হওয়া দরকার। যে সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে বোঝা হয়ে যাচ্ছে, বৈজ্ঞানিক উপায়ে তার মোকাবিলা করা দরকার। শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা দরকার। অপরাধের পরিবেশ যাতে তৈরি না হয়, সে দিকে নজর দেওয়া দরকার। নইলে সমাজ এমনিতেই উচ্ছন্নে গিয়েছে, আরও যাবে। সে কেবল কবে মেয়েরা অপরাধ করবে বলে অধঃপাতে যাওয়ার অপেক্ষায় নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

girls Offence Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE