আসানসোলে নাকি পুলিশ ‘কাজ করিতেছে না’, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের অভিযোগ। অভিযোগটি চিন্তায় ফেলিবার মতো। এত গুরুতর পরিস্থিতিতেও যদি পুলিশ ‘কাজ না করে’, তবে যে আইনশৃঙ্খলার আরও দ্রুত অবনতি হইবে, ইহা উদ্বেগের বিষয়। উদ্বেগের আসল কারণটি আরও বড়। পুলিশ-প্রশাসন পরিস্থিতির রাশ নিজেদের হাতে আনিতে না পারিলে এ-রাজ্যের বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের একত্র সহাবস্থানের ছবিটি ছিঁড়িয়া ফেলিবার সচেতন রাজনৈতিক উদ্যোগটিই দ্রুততর বেগে সফল হইবে। কী ভাবে সম্প্রদায়-উত্তেজনা ছড়ায়, ইতিহাস বহু বার দেখাইয়াছে। সুতরাং সম্প্রদায়-উত্তেজনার রেশমাত্র ঘটিলেই তাহাকে অঙ্কুরে বিনাশ কর্তব্য। সেই কর্তব্য সাধনে পশ্চিমবঙ্গে অতীতে বহু বার কৃতিত্ব অর্জন করিয়াছে। আসানসোলেও তেমনই হইবে, আশা ছিল। ঝুঁকি যেখানে বিরাট, সেখানে সামান্য গাফিলতি বা আলস্য বা অক্ষমতারও ক্ষমা নাই।
প্রশ্ন হইল, পুলিশের ‘কাজ না করিতে’ পারিবার পিছনে অন্য কোনও পক্ষের দায়িত্ব নাই তো? বাবুল সুপ্রিয় আক্ষেপ করিয়াছেন বটে। কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধেই যে এফআইআর দায়ের হইয়াছে— তিনি পুলিশের কর্তার সহিত সংঘর্ষে লিপ্ত হইয়াছেন! সংঘর্ষের প্রেক্ষিত— হিংসাদীর্ণ অঞ্চল চাঁদমারি ও কল্যাণপুরে বাবুল সুপ্রিয় ঢুকিতে চাহিয়াছেন, কিন্তু পুলিশ তাঁহাকে বাধা দিয়াছে। এখন, সাধারণ ভাবে সংঘর্ষের সময়ে কোথায় কে ঢুকিতে পারেন, ইহা পুলিশ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই হইবার কথা। সেখানে সাধারণ মানুষ এবং মন্ত্রী বা সাংসদের ফারাক নাই। তবে কি এই প্রশ্ন উঠে না যে বাবুল সুপ্রিয়ই অকারণ জেদ করিতেছিলেন, পুলিশের কাজে বাধা দিতেছিলেন? বিশেষত যখন আগের দিনই তিনি একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করিয়া ভিডিয়ো ফুটেজ এবং টুইটার প্রচার করিয়াছেন? পুলিশ কি বলিতে পারে না যে, এমন কাণ্ড যিনি করেন, উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চলে তিনি ঢুকিলে শান্তি ফিরাইবার ‘কাজ’টি বহু গুণ কঠিন হইয়া যাইবে? বাবুল সুপ্রিয়ের যে কর্মপদ্ধতি গোটা রাজ্য দেখিতেছে, তাহাই কি যথেষ্ট উদ্বেগজনক নহে? কোনও নেতা তথা সাংসদ তথা মন্ত্রীর এমন ভূমিকাকে কি ‘দায়িত্বশীল’ বলা চলে?
মন্ত্রী বলিতেই পারেন, তাঁহার কাছে দায়িত্বশীলতার অর্থ, ঘটনার ‘বিবরণ’ সকলকে জানানো। বস্তুত তিনি ইহা ইতিমধ্যেই বলিয়াছেন। উত্তরে আরও দুইটি প্রশ্ন। প্রথমত, যে ঘটনার ‘বিবরণ’ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে জানেন, তাহাই কি ‘একমাত্র’ ঘটনা? ঘটনার পিছনে অনেক সময়ই আরও ঘটনা থাকে, অনেক সময় নিহিত প্রচ্ছন্ন ভাবেও থাকে। তাই একটিমাত্র বিবরণ কখনওই প্রামাণ্য হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত, যদি বা এই বিবরণ সত্য হয়, তবু একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে অভিযুক্ত করিয়া এমন বার্তার প্রচার কি ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন আরও জ্বালায় না? মন্ত্রী কি তাহাই চান? যদি না চান, তবে বিবরণ প্রচার করিয়া কী লাভ? বাবুল সুপ্রিয় হয়তো জানেন না, অনেক দিন আগে দেশের এক প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখিয়া সতর্ক করিতেন যে, সংখ্যালঘু জনতার কোন আচরণ অবাঞ্ছিত, বারংবার তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিলে অশান্তি বাড়ে বই কমে না। শান্তি স্থাপন করিতে হইলে সংখ্যাগুরু সমাজকে তুলনায় বেশি সহিষ্ণু হইয়া সংখ্যালঘুর আস্থা অর্জন করিতে হয়। জওহরলাল নেহরু দৃশ্যত নরেন্দ্র মোদীর চক্ষুশূল। সুতরাং অনুমান করা যায়, তিনি বাবুল সুপ্রিয়ের পছন্দের ব্যক্তি নহেন। কিন্তু দলীয় নেতার পদ ছাপাইয়া বাবুল যখন মন্ত্রী পর্যন্ত হইয়াছেন, তখন দলীয় আদর্শের বাহিরে বার হইয়া প্রশাসনিক শৃঙ্খলার দিক দিয়াও বিষয়টিকে দেখিতে পারেন। নেহরুর কথাগুলির মর্ম হয়তো তবে কিঞ্চিৎ বুঝিবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy