Advertisement
১১ মে ২০২৪

অতিপৌরুষ

সুদিনের অপেক্ষায়। ফাইল ছবি

সুদিনের অপেক্ষায়। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০০:৪১
Share: Save:

কালক্রমে, এবং কালের নিয়মে, নারী দিবসের তেজ কমিয়াছে, ধারও। এক দিকে অর্থহীন আচার অনুষ্ঠান এবং অন্য দিকে অর্থসর্বস্ব বিপণনের বাজার দিনটিকে অনেকখানি গ্রাস করিয়া লইয়াছে। কিন্তু এই তারিখটির প্রতীকী মূল্যকে নস্যাৎ করিতে ব্যগ্র হইয়া যাঁহারা ‘তবে পুরুষ দিবসই বা হইবে না কেন’ মার্কা ছেঁদো কথা আওড়াইয়া চলেন তাঁহারা হয় অজ্ঞ, নতুবা জ্ঞানপাপী। নারী দিবসের তাৎপর্য আজও অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তাহার কারণ নারীপুরুষ সমতা আজও দূর অস্ত্, পিতৃতন্ত্র আজও সজীব, সক্রিয় এবং বহু ক্ষেত্রেই, এমনকি— ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ নামক জাগরণের সাম্প্রতিক কাহিনি স্মরণীয়— উন্নত দুনিয়ার অতি-আধুনিক মহলেও পরাক্রমশালী। আবার ওই কাহিনিই নূতন করিয়া জানাইয়া দিয়াছে, পিতৃতন্ত্রের সদর দফতরে কামান দাগিবার কাজটি নিরন্তর চালাইয়া যাওয়া কেন আবশ্যক— লড়াই করিতে পারিলে ফল লাভ হয়, পিতৃতন্ত্রের দুর্গপ্রাকারে ফাটল ধরানো যায়, নূতন নূতন ফাটল। যথার্থ নারীবাদ কেন মজ্জায় মজ্জায় রাজনৈতিক, এই দৃষ্টান্ত তাহাও বুঝাইয়া দিয়াছে। দলবাজির ক্ষুদ্র অর্থে নহে, ক্ষমতার টানাপড়েনের বৃহৎ অর্থে রাজনৈতিক। নারী দিবস, তাহার প্রবল আচারসর্বস্বতা সত্ত্বেও, সেই রাজনীতির প্রতীক।

এই প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন ওঠে, ফলিত রাজনীতির পরিসরে পিতৃতন্ত্রের দাপট কি কিছুটা কমিল? এই প্রশ্ন তুলিবার পক্ষে নারী দিবস প্রশস্ত লগ্ন, বিশেষত দিনটি যখন নির্বাচনী মরসুমের হাতে হাত মিলাইয়া অবতীর্ণ। প্রতি নির্বাচনে এবং নির্বাচনোত্তর আইনসভায় যথাক্রমে প্রার্থী ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে পুরুষ ও নারীর আনুপাতিক সংখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়, সেই অনুপাতের উত্থানপতনের মাত্রা মাপিয়া ঘোষণা করা হয়, রাজবৃত্তে পিতৃতন্ত্রের প্রভাব কতটা কমিল বা বাড়িল। অনুরূপ ভাবেই বিচার করা হয় মন্ত্রিসভায় মেয়েদের অনুপাত। সংখ্যার হিসাবে সীমিত না থাকিয়া বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনে বা জনপ্রতিনিধিসভায় মেয়েরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিতেছেন তাহার বিচার-বিশ্লেষণও সুপ্রচলিত। এই সব বিচার অবশ্যই দরকারি। যদিও, সুবিচারের জন্য গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, উপর উপর দেখিলে ভুল হইতে পারে। বিদেশ বা প্রতিরক্ষার মতো অতি-গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের শীর্ষে নারীর অধিষ্ঠান সত্ত্বেও যে প্রকৃত ক্ষমতার লাগাম সম্পূর্ণত পুরুষের হাতে থাকিতে পারে, চক্ষুষ্মান ভারতবাসী তাহা বিলক্ষণ জানেন। পঞ্চায়েত পুরসভা হইতে সংসদ, জেলা প্রশাসন হইতে কেন্দ্রীয় সরকার, সর্বস্তরে মেয়েদের উপস্থিতি এবং পদোন্নতি জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নহে। প্রয়োজন তাঁহাদের হাতে প্রকৃত অধিকার ও কাজের সুযোগ আরও অনেক বেশি পৌঁছাইয়া দেওয়া।

কিন্তু তাহার পরেও আর একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। পিতৃতন্ত্র শেষ বিচারে পুরুষের আধিপত্য নহে, পৌরুষের আধিপত্য। পৌরুষের একটি বিশেষ ধারণার আধিপত্য। সেই ধারণার মূলে থাকে অন্যকে দমন করিবার প্রবল তাগিদ। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির দিকে চাহিলেই তাহার স্বরূপ বুঝিয়া লওয়া যায়। যে উগ্র, অপর-বিদ্বেষী অতিজাতীয়তার তাণ্ডব দেশ জুড়িয়া চলিতেছে, তাহার অন্তরে নিহিত রহিয়াছে ‘মাচো’ অতিপৌরুষ। ছাতির মাপ তাহার বহিরঙ্গ রূপমাত্র, অন্তর্নিহিত আধিপত্যকামিতার গরল আরও অনেক বেশি ক্ষতিকর, তাহাকে ইঞ্চির মাপকাঠিতে ধরা অসম্ভব। জনসমাজেও এই উগ্র অতিপৌরুষের প্রভাব দ্রুত বাড়িতেছে, সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতি তাহা হইতে রসদ সংগ্রহ করিতেছে এবং তাহাকে লালনও করিতেছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙিতে না পারিলে, সমাজ ও রাজনীতিতে উদার সহমর্মিতার সুধর্মকে ফিরাইতে না পারিলে পিতৃতন্ত্রই বিজয়ী হইবে। ব্যক্তি-নারীর সাফল্যের মাত্রা যাহাই হউক না কেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE