জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ যাবৎ নেহরু সম্পর্কে তাঁর নানা মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে এই নতুন বার্তা বিস্ময়কর ঠেকতে পারে। এই স্বীকৃতির পিছনে গূঢ় কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না সে প্রশ্নও তুলতে পারেন কেউ। কিন্তু সে সব প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে আপাতত একটি বিষয়ে অভিনিবেশ করা যাক: জওহরলাল নেহরু।
প্রথমেই বলা দরকার, নেহরু একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেড়ে উঠেছিলেন এবং এমন বহুজনের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন যা অবশ্যই মোদীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যই হল নানা বিরোধী মতামতের মধ্যে একটি সেতু রচনা করা। যেটা মহাত্মা গাঁধী করতে পেরেছিলেন। দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী সবাই গাঁধীর নেতৃত্বকে এই জন্য মেনে নিয়েছিলেন। নেহরু সেই ঐতিহ্যকে বহন করেছেন। তার প্রথম প্রকাশ হল এক দিকে শুরু থেকেই নিজের পছন্দ অনুযায়ী মতামত জানানো এবং অন্য দিকে নেতৃত্বকে প্রশ্ন করার অভীপ্সা। নেহরু দ্বিধাহীন ভাবে এমনকি নিজের পিতার বিরোধিতা করেছেন। বিরোধী বক্তব্য নেহরু বিশেষ ভাবে পছন্দ করতেন। আজকের মতো বিরোধীদের ভেংচানো বা তাঁদের পিতামাতার নাম করে গালিগালাজ করাটা আমাদের সংসদীয় ঐতিহ্য নয়। তর্কশীলতা আমাদের গণতান্ত্রিক অভ্যাসের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। বিরুদ্ধ মত মানেই যে শত্রুতা নয়, তা দেশের ওই প্রবল সঙ্কটের মুহূর্তগুলিতেই স্থির হয়ে গিয়েছিল।
আজ কতকগুলো প্রশ্ন বার বার উঠে আসছে। যেমন, জাতীয়তাবাদের বিশেষ একটি নির্মাণকে যদি আমরা মেনে না নিই, তবে আমাদের দেশপ্রেম প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। জাতীয়তাবাদের এই বিশেষ রূপটি মোটেই গণতান্ত্রিক নয়। নেহরু চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের নেতা হতে আর সেই গণতন্ত্রের ভিত্তিই হল বিভিন্ন মতামতের সহাবস্থান। জাতীয়তাবাদী চিন্তাও তার বাইরে নয়। সেখানেই ছিল নেহরুর গণতান্ত্রিক ভাবনার প্রথম পরীক্ষা। সবাইকে নিয়ে চলার মনোভাব তিনি পেয়েছিলেন পারিপার্শ্বিক থেকে। তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনায় এক দিকে গাঁধীর প্রভাব, অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথের। ফ্যাসিবাদ হল জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী ভাবনার চরম রূপ। নেহরু তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর মত ছিল ভারতের ক্ষেত্রে ওই জাতীয়তাবাদী ভাবনা কখনওই কার্যকর হবে না। জোর করে চাপানোর চেষ্টা হলে নিশ্চিত ভাবেই তা একটি বিকৃত ফ্যাসিবাদী রূপ নেবে। একের ভাবনা নয়, এ দেশ চলতে পারে বহুর সাধনার মধ্যে দিয়ে।
আর একটি কথা মনে রাখা এখন বিশেষ জরুরি। নেহরু সর্বদাই চেষ্টা করেছেন যাতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংসদীয় ব্যবস্থার কোনও মিশ্রণ না ঘটে। জেনারেল থিমাইয়াকে নিয়ে সঙ্কটের পরে এক বিশেষ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু সংসদকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, ‘‘সিভিল অথরিটি ইজ়, অ্যান্ড মাস্ট রিমেন, সুপ্রিম।’’
গণতন্ত্র সম্পর্কে নেহরুর ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেও। এখন সংসদকেন্দ্রিকতা থেকে আমরা ক্রমশই নেতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। দলমতনির্বিশেষে। গণপরিষদের সতীর্থদের সহায়তায় নেহরু সংসদীয় ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই ব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, যাবতীয় ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকবে। ব্রিটিশ মডেলে এমনকি বিচারব্যবস্থারও বিশেষ স্বাধীনতা অনেক দিন অবধি ছিল না। নেহরু, অম্বেডকররা বিচারবিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন। বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার মার্কিন মডেলটির একটি কাঠামো আমাদের দেশেও প্রস্তুত হয়েছে যেখানে সংসদ প্রণীত কোনও আইনকে পর্যালোচনা করা এবং উচিত মনে হলে সংবিধানবিরোধী ঘোষণা করা যায়। এটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ‘ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ’-এর একটি অসামান্য মেলবন্ধন।
নেহরুর গণতান্ত্রিক ভাবনা প্রতিফলিত তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তার মধ্যেও। মার্ক্সীয় চিন্তা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। সোভিয়েটের কর্মকাণ্ডের নির্যাসটিকে এ দেশের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। শ্রেণিশোষণের মৌলিক ব্যবহারিক বাস্তবতার সঙ্গেও নেহরুর কোনও বিরোধ ছিল না। কিন্তু তিনি অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন ফেবিয়ান সমাজবাদের গণতান্ত্রিক ভাবনার দ্বারা। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা শুধু পুঁথিনির্ভর ছিল না, সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাবতীয় ভাবনার নির্যাসকে বাস্তবে প্রয়োগ করতেও হয়েছে, মিশ্র অর্থনীতির ধারণা যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। ভুল-ঠিকের হিসেব করছি আমরা, যারা বাতায়ন রাজনীতি ছাড়া কিছু করি না।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটটিও ছিল বাতাহত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী তখন দ্বি-মেরুকৃত। তাত্ত্বিকরা বললেন, ঠান্ডা লড়াই। প্রথম ভাঙন এল সোভিয়েট ব্লকে। যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো সরাসরি সোভিয়েটের দাপট মানতে অস্বীকার করলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হল সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত আফ্রো-এশীয় দেশগুলির ন্যায্য দাবিদাওয়া। দ্বি-মেরুকৃত বিশ্বে গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীন সত্তার স্ফুরণ প্রতি মুহূর্তে ব্যাহত হচ্ছিল। প্রধানত নেহরুর উদ্যোগেই চালু হয় পঞ্চশীল নীতি, যা জাতিরাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রধান কান্ডারি। টিটো, নাসের, নেহরুরা বুঝেছিলেন ঠান্ডা লড়াইয়ের ফাঁদে পা দিলে আন্তর্জাতিক স্তরে কখনওই গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নির্মিত হতে পারবে না। বহুস্বরকে প্রাধান্য দিতে পারলেই দু’টি চিহ্নিত স্বরের একাধিপত্য কমানো সম্ভব হবে।
রাজনৈতিক বিশ্বাস বা তার প্রয়োগ কখনও ব্যক্তিনিরপেক্ষ হয় না। ব্যক্তিগত স্বভাব রাজনৈতিক আচরণেও ফুটে ওঠে। রাজনীতি বলতে যদি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রমণ বুঝি তবে মানতেই হচ্ছে মননেও আমরা গণতান্ত্রিক নই। অন্যের অবস্থানের বিরোধিতা করেও তাঁর মেধা ও মননের গুণগ্রাহী হওয়ার বিরল প্রতিভা ছিল নেহরুর। ১৯৩৩ সাল। নেহরু তখন স্বাধীনতা যোদ্ধা, জননেতা। বিশ্ববিশ্রুত কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায় জেলবন্দি, অত্যন্ত অসুস্থ। ব্রিটিশ জেল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট চিকিৎসার বন্দোবস্ত করছেন না। পরিস্থিতি ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। নেহরু এগিয়ে এলেন। ১৯ অক্টোবর প্রেস বিবৃতি জারি করে জানালেন যে এই পরিস্থিতি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তিনি বললেন যে মানবেন্দ্রনাথ ‘‘ভারতের বর্তমান প্রজন্মের নির্ভীকতম ও যোগ্যতম এক সন্তান।’’ এ-ও জানালেন যে ১৯২৭-এ যখন প্রথম বার তিনি মস্কোয় রায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তখনই রায়ের বুদ্ধির দীপ্তিতে আকৃষ্ট হন, যদিও রায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন। নেহরুর প্রতি তিনি আকর্ষণ বোধ করেননি। রায়ের কথাবার্তায় তিনি আহতও হয়েছিলেন বলে নেহরু জানান। তবু তাঁর কাছে মানবেন্দ্রনাথের গুরুত্ব হারায়নি।
এই হলেন নেহরু। ব্যক্তিজীবন আর রাজনৈতিক জীবনে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের নির্যাস, যা শুধু কাঠামোনির্ভর নয়, প্রাণদীপ্ত। নরেন্দ্র মোদী প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। পারলে, তাঁর গণতান্ত্রিক মানসিকতার গুণটি আয়ত্ত করুন। সমালোচনা সহ্য করুন। নিজেকে নিয়েও হাসতে শিখুন।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy