Advertisement
E-Paper

সমাজে অবস্থানের বৈষম্যই নারীশিক্ষার প্রধান অন্তরায়

যদি মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করা হয়, তখন তিনি শুধু মাত্র নিজের নয়, তাঁর সন্তানদের, তাঁর সম্প্রদায় এবং তাঁর জাতির খাদ্য সরবরাহ করেন। লিখছেন লিপিকা বিশ্বাস সাহাবর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা মাধ্যম  বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ্য নবকৃষ্ণ ভট্টচার্যের লেখা ‘বিমলার অভিমান’ কবিতায় একটি ছোট্ট মেয়ের শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার জন্য  বিভিন্ন ফাইফরমাশ খাটার ফলে যে অভিমান, তা বেশ ভাবায়। ‘‘দাদা বড়ো, বেশি বেশি খাবে দাদা তাই,/অবু বেশি খাবে-আহা সেটি ছোটো ভাই;/ দুধারে সোনার চুড়ো, মাঝেতে ছাইয়ের নুড়ো/তাই বুঝি বিমলার কমে গেছে দাম-ই-/খাব না তো আমি!' একুশ শতকেও কিন্তু এটিই আমাদের  সমাজচিত্র তথা পরিবারে মেয়েদের অবস্থানচিত্র।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০২:৩৪

বছর চারেক আগের কথা। পরীক্ষা কেন্দ্রে মাধ্যমিক পরীক্ষায় নজরদারি করছি। এক ছাত্রীর খাতা সই করতে গিয়ে চমকে উঠলাম! নাম লেখা আছে অনিচ্ছা। ইতি, সমাপ্তি শুনেছি। একাধিক মেয়ে না চাওয়া থেকেই মেয়েদের এই ধরনের নাম হয় জানি। তবে মেয়ের নাম অনিচ্ছা এই প্রথম দেখলাম। ওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ছেলে-ছেলে করে মেয়ে হওয়া চতুর্থ কন্যাসন্তান ও।

এই হল, আমাদের সমাজে কন্যাসন্তানের সামাজিক সম্মানের চালচিত্র। এই চালচিত্র ভেদ করে যদি মেয়েদের শিক্ষাচিত্রের দিকে তাকানো যায়, তবে দেখা যাবে নানা বিধিনিষেধের দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছেন তাঁরা।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ্য নবকৃষ্ণ ভট্টচার্যের লেখা ‘বিমলার অভিমান’ কবিতায় একটি ছোট্ট মেয়ের শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার জন্য বিভিন্ন ফাইফরমাশ খাটার ফলে যে অভিমান, তা বেশ ভাবায়। ‘‘দাদা বড়ো, বেশি বেশি খাবে দাদা তাই,/অবু বেশি খাবে-আহা সেটি ছোটো ভাই;/ দুধারে সোনার চুড়ো, মাঝেতে ছাইয়ের নুড়ো/তাই বুঝি বিমলার কমে গেছে দাম-ই-/খাব না তো আমি!' একুশ শতকেও কিন্তু এটিই আমাদের সমাজচিত্র তথা পরিবারে মেয়েদের অবস্থানচিত্র।

ভারতের অধিকাংশ গ্রামে পারিবারিক কাজকর্মে অন্য মহিলা সদস্যদের সাহায্য করে প্রধানত ছোট ছোট মেয়েরা যাঁরা মানবজাতির ভবিষ্যৎ ধারক ও বাহক। মূলত গরু-ছাগল চরানো, অনেক দূর থেকে পানীয় জল আনা, খেতখামারে খাবার পৌঁছে দেওয়া, জ্বালানির জন্য কাঠ কুড়িয়ে আনা, পরিবারের সব চেয়ে ছোট সদস্যদের কোলেপিঠে নিয়ে মানুষ করা ইত্যাদি।

ভারতে লিঙ্গভেদে শিক্ষাগত তারতম্য লক্ষণীয়। আমাদের সমাজব্যবস্থা ও বিশাল জনসংখ্যার এখনও দৃঢ় বিশ্বাস গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করার জন্য মেয়েদের বাড়িতে থাকা খুব দরকার এবং তাই পরিবারের মাথা এমনকি মায়েরাও তাঁদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে অনিচ্ছুক। ভারতে জনসংখ্যার বেশির ভাগই দরিদ্র। গ্রামীণ এলাকায় একটি বড় সংখ্যক শিশু অপুষ্ট। অর্থাভাবে তাঁরা তাঁদের সব শিশুর শিক্ষার সুযোগ দিতে যেমন পারেন না, তেমনই যখন ছেলে বা মেয়েকে শিক্ষালাভ করাবে এই পছন্দ আসে, লিঙ্গবৈষম্যের কারণে তাঁরা তাঁদের মেয়ের পরিবর্তে ছেলেদের শিক্ষার উপর বিনিয়োগ করতে পছন্দ করেন বেশি।

সমাজের অন্ধবিশ্বাস, ছেলে বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে দেখবে এবং অপর দিকে মেয়েটির বিয়ে হলে সে অন্য পরিবারে চলে যাবে। যৌতুকের জমানো অর্থ নিয়ে। অতএব, কন্যাসন্তানের শিক্ষার যত্ন পরিবার থেকে তেমন ভাবে নেওয়া হয় না। মেয়েদের পড়াশোনার উপর অর্থ বিনিয়োগ তাই টাকা ও সময় নষ্ট বলে বিবেচিত। তবে এই পিতামাতাই মেয়ের বিয়েতে উচ্চ পণ দিয়ে জাঁকজমক করে খরচ করতে পিছপা হন না। আবার, যে সব পরিবার চায় না কন্যাসন্তান চাকরি করুক, তারা মনে করে না যে, মেয়েদের শিক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা আছে।

আমাদের দেশে রক্ষনশীল মানসিকতার জন্য মেয়েদের মর্যাদা সব সময়েই ছেলেদের নীচে। তাই এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ গ্রামের চিত্রই এই যে, নারীদের বাড়িতে থাকাটাই যথোপযুক্ত এবং তাঁদের একমাত্র কাজ হল স্বামী ও পরিবারকে সেবা করা এবং সন্তানদের জন্ম দেওয়া। কিন্তু সমাজ তথা দেশের উন্নতির জন্য আসল কথা হল—অসহযোগিতার বদলে যদি মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করা হয়, তখন তিনি শুধু নিজের নয়, তাঁর সন্তানদের, তাঁর সম্প্রদায় এবং তাঁর জাতির খাদ্য সরবরাহ করেন। তাই একটি মেয়েশিশুর শিক্ষা হল একটি দেশের সুস্বাস্থ্য ও উন্নয়নের প্রথম পদক্ষেপ।

পরিবারের অসহযোগিতা যেমন কন্যাসন্তানের শিক্ষালাভের অন্যতম অন্তরায়, তেমনই কন্যাসন্তানের অল্প বয়সে বিয়ে ও সন্তান জন্ম দেওয়া নারীরশিক্ষার একটি প্রধান নির্ণায়ক কারণ। বিশেষ করে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাতে কম বয়সে বিবাহের ফলে লক্ষ লক্ষ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত। তবে কিছু কিছু উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বিবাহের ক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীর চাহিদার কারণে নারীশিক্ষায় উৎসাহ দেওয়া হয়। যদিও মেয়েরা কোনও পণ্য নন, তবুও এটি মানতেই হবে বিবাহ নামক বাজারে শিক্ষিত নারীর চাহিদা লক্ষণীয়। ভারতের সার্বিক চিত্র হল, সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে, গোঁড়া মানসিকতার জন্য ভারতে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম হারে বিদ্যালয়ের আঙিনামুখী। তবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে ভারতের শহরের সঙ্গে গ্রামের পরিবেশের আকাশপাতাল পার্থক্যের হেতু শহরাঞ্চলে নারীশিক্ষার হার বেশি। ভারতে মহিলাদের সার্বিক সাক্ষরতার হার ৬৫.৪৫ শতাংশ, যেখানে সাক্ষরতার হার পুরুষদের ক্ষেত্রে ৮২.১৫ শতাংশ। এই ব্যাপক ব্যবধান সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের উপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নারী-সাক্ষরতার হার কম হওয়ার কুপ্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসে। গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, নারী সাক্ষরতার ফলে বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ে। এমনকি, তাঁরা আর্থিক ভাবে সাবলম্বী না হলেও। এনএসএস তথ্যানুসারে , শহরাঞ্চলে নারীশিক্ষার হার ৭৪.৮ শতাংশ হলেও গ্রামাঞ্চলে এই হার অনেকাংশেই কম ৫৬.৮ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে গ্রামাঞ্চলে নারীশিক্ষার একটি দৈন্য ছবি প্রকট হয়।

বাড়ি থেকে বিদ্যালয় দূরত্ব নারীশিক্ষা বিস্তারে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছানোর জন্য গ্রামীণ এলাকার মেয়েদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই পথ দুর্গম হয়ে থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই পরিবার বিশেষত, মায়েরাই নিরাপত্তার কথা ভেবে মেয়েদের স্কুলে পাঠান না। মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ছেলেদের স্কুলের তুলনায় শুধুমাত্র মেয়েদের স্কুলের যেমন অভাব রয়েছে তেমনি অনেক অভিভাবকই পছন্দ করেন না যে, তাঁদের মেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে হোস্টেলে থাকবে। রক্ষণশীল সমাজে এখনও অনেক মানুষের কাছে কো-এডুকেশন বা সহ-শিক্ষা ধারণাটি নিন্দনীয় ও চূড়ান্ত অপছন্দের। তাঁদের আদিম অভিমত, ছেলে-মেয়ে উভয়েই যদি একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একত্রে পড়াশোনা করে, তবে তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।

শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক

International Women's Day Women's Day Special Feminism
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy