সকালের দিকটা শীত শীত করছে, নলেন গুড়, মিঠে রোদ— আয়েশ জমজমাট। কিন্তু আর একটা শীত রয়েছে। সত্যিকারের ঠান্ডা শীত, প্লাস্টিকের ছাউনি, লক্ষ লক্ষ মানুষ, সোয়েটার-কম্বল দাক্ষিণ্যনির্ভর বিলাস, উদ্ধার অসম্ভব, খেদানি অবশ্যম্ভাবী। মৃত্যু যখন তখন কাছাকাছি। এ হল রিফিউজি ক্যাম্পগুলোর শীত। দুনিয়া জুড়ে অন্তত দু’কোটি মানুষ এখন শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। সেই সব ছাউনিতে এখন শীত নামছে।
এই ছাউনিগুলির কিছু কিছু রয়েছে একেবারে অকূলপাথারের মাঝখানে। নানান দ্বীপে। সেই সব দ্বীপভূমিতে লড়াই করছেন রিফিউজিরা। ইরাক বা সিরিয়ার অন্তত দশ হাজার শরণার্থী ঘাড়-মুখ গুঁজে রয়েছেন গ্রিসের লেসবস, সামোস চিয়োস-এর মতো দ্বীপগুলিতে। এক একটা ক্যাম্পে যত জন মানুষ থাকতে পারে, তার চেয়ে তিন গুণ মানুষ চাপাচাপি করে বাঁচতে চাইছেন। এমন ঠাসাঠাসি চলছে যে সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে এক তাঁবুতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন নারী, এবং উল্টোটাও সত্যি। ফলে নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলাই বোকামি। এ বার এই সব জায়গায় যোগ্যতমের উদ্বর্তনের নিয়ম যাচাই হবে। পরিত্রাণ, নিষ্কৃতি আর বাঁচার তাগিদের মধ্যে শেষটির জোর যত বেশি হবে, ডারউইন তত সত্য প্রমাণিত হবেন।
গ্রিসের দ্বীপগুলোয় যে সব শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের সে দেশের মূল ভূখণ্ডে যাওয়া মানা। দশ হাজারের মধ্যে মাত্র দু’হাজার শরণার্থীকে আইনি ব্যবস্থায় গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বাকিদের জন্য রাস্তা বন্ধ। কিন্তু এই সব দ্বীপে বাঁচার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অমিল। রিফিউজিদের যা হচ্ছে, তা তো হচ্ছেই, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’-এ দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন। লেসবস দ্বীপের বাসিন্দারা বলছেন, তাঁদের বসবাসের জায়গাটিকে একটি আস্ত রিফিউজি জেল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সেই জেলে যাঁরা বাস করছেন, তাঁদের তো জীবন বাঁচার অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তার ওপর ভয়ংকর শীত তো এসেই পড়ল। এই শীতে যে কত শরণার্থী মারা যাবেন, তাঁদের মধ্যে কত বৃদ্ধ ও শিশু থাকবে, কত জনের প্রাণসংশয় হবে, তার হিসেব কষতে হলে বুকের পাটা লোহা দিয়ে তৈরি হতে হবে।
শীত পড়ছে মানুস দ্বীপেও। পাপুয়া নিউ গিনির দ্বীপটায় আটকে পড়ে রয়েছেন প্রায় সাতশো মানুষ, সকলেই পুরুষ। এঁরা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয়েছেন। এখানে প্রাকৃতিক জেল না তৈরি করে একেবারে বাঁধাধরা গতে আটকে রাখা হয়েছে মানুষগুলোকে। তাঁদের জন্য আছে ভাড়া করা নিরাপত্তা কর্মী। বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক সময় স্থানীয় লোকেদের দাবড়ানি খেতে হয় এই কয়েদিদের। রাগারাগি হাতাহাতি, ভয়ংকর মারপিট অবধি পৌঁছয়। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় দেহমন। অথচ তাঁরা বেঁচে আছেন। কেন? মরে যাননি বলে। অনেকে অবশ্য আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন। কেউ কাঁচি গিলে নিয়ে, কেউ ব্লেড চিবিয়ে।
অস্ট্রেলিয়া এই শরণার্থীদের বিষয়ে পাপুয়া নিউ গিনিকে সাহায্য করবে বলেছিল। কিন্তু এখন তা নিয়ে রীতিমত সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন অস্ট্রেলীয় সরকারের সঙ্গে আমেরিকার একটি বোঝাপড়া হয়েছিল যে, আমেরিকা এই শরণার্থীদের আশ্রয় ও দেখভালের জন্য সাহায্য করবে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে সেই সব চুক্তি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। সুতরাং রিফিউজিরা ভয়ে আছেন, অস্ট্রেলিয়াও মুখ ফেরাতে পারে। সম্প্রতি এই কয়েদখানায় আলো, জল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে। বন্দিদের মধ্যে এক জন কুর্দ সাংবাদিক সৌরশক্তির সাহায্যে নিজের মোবাইল ফোনে চার্জ দিয়ে টুইটারের মাধ্যমে তাঁদের এই প্রচণ্ড অমানবিক অবস্থা, এই বুক নিংড়ানো যন্ত্রণার কথা জানানোর চেষ্টা করে চলেছেন।
আর, ও-দিকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা, পচে-গলে-মরে যাওয়া রোহিঙ্গারা? তাঁরাও দ্বীপান্তরের বাজনা শুনছেন। প্রায় ছয় লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় দিতে অক্ষম। তাই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঠিয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে জনমানবহীন এক চরে— ঠেঙার চর। যে চর কখনও জলের তলায় ডুবে যায়, কখনও জেগে ওঠে। জোয়ারভাটার মতিগতির ওপর নির্ভর করে তার অস্তিত্ব। এমন জায়গায় পাঠানোর কারণ? এত লোক থাকবে কোথায় দেশের মধ্যে? সে জন্য একটা অন্য জায়গায় এদের বসবাসের ব্যবস্থা করা। তা ছাড়া, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি থাকতে পারে, সেই ভয়ও আছে। কালাপানি পার হয়ে সহজে জঙ্গিপনা ছড়ানো যাবে না। সে দিক থেকেও এই চর নিরাপদ।
কিন্তু বাঁচার রসদ কই? হেলিকপ্টার কিছু দিন উড়িয়ে আনবে ত্রাণ, হয়তো বা জলপথে খাবার এসে পৌঁছবে কিছু দিন। কিন্তু কিছু দিন পর কী হবে? ত্রাণ পৌঁছনোর হিড়িক কমবে, গাফিলতি আর ঔদাসীন্য তার জায়গা নিয়ে নেবে। অথচ শীত কিন্তু রেয়াত করবে না। তখন ডারউইনের অন্য সূত্রটি প্রমাণিত হবে— প্রাকৃতিক নির্বাচন। পাঁজরের-হাড়-বের-করা শরণার্থীদের জন্য প্রকৃতির প্রশ্নপত্র সহজ হবে না। নেচারের মার খেতে খেতে, তার সঙ্গে লড়াই করে যে ওই চরে টিকে থাকতে পারবে, সে-ই বেঁচে থাকার যোগ্য হবে— ন্যাচরাল সিলেকশন।
আর তার পর? তার পর দুনিয়ার নানা দ্বীপ আর চর জুড়ে আস্তে আস্তে অ্যামিবা-সময় থেকে এই রিফিউজিরা তৈরি করতে শুরু করবে নতুন জনপদ, সেই জনপদ থেকে তৈরি হবে নতুন দেশ। প্রথমে দু’দলের বা চার দলের লড়াই হবে, তার পর মধ্যস্থতা, আর তার পর একটা করে নতুন দেশ গজিয়ে উঠবে মানচিত্রে— রিফিউজিস্তান, রিফিউজি নেশন, রিপাবলিক অব রিফিউজিস। এই বা কম পাওয়া কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy