বুলন্দশহরে যাহা ঘটিয়া গিয়াছে, এবং তাহার জন্য যে পথে তদন্ত হইতেছে— মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সেই সব কিছুর জন্য প্রশংসা ও ধন্যবাদ দাবি করিয়াছেন। অবশ্যই, এই দাবি তিনি এক শত বার করিতে পারেন, কেননা তাঁহার ধ্যানধারণা প্রশাসনপদ্ধতি সব কিছু এই তদন্তে নিতান্ত বিশ্বস্ত ভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। বুলন্দশহরে গোহত্যার ‘অভিযোগ’-এ গণহিংসার আগুন জ্বলিয়া উঠিলে তাহা থামাইতে ব্যস্ত পুলিশ ইনস্পেক্টর হিংসার বলি হন। ঘটনার তদন্ত করিতে নামিয়া যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন প্রথমে গোটা ঘটনাটিকে ‘নিছক দুর্ঘটনা’ ও পরে ‘চক্রান্ত’ বলে, ইনস্পেক্টর মহাশয়ের নিধনের অপেক্ষা গো-নিধনকেই বড় অপরাধ হিসাবে সাব্যস্ত করে, এবং সর্ব উপায়ে ইনস্পেক্টরের হত্যার প্রতিকারে অনীহা দেখায়। নিহত ইনস্পেক্টরের আনুমানিক ‘অপরাধ’: তিনি কেবল গোহত্যা-তাণ্ডব থামাইবার চেষ্টা করেন নাই, কয়েক বৎসর আগে ঘটিয়া যাওয়া আর এক কুখ্যাত গণহিংসাকাণ্ডে নিহত মহম্মদ আখলাক নামে দাদরি-নিবাসী যুবার মৃত্যুর তদন্তও করিতেছিলেন। সুতরাং, গোটা ঘটনার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ প্রশংসা দাবি করিতেই পারেন। কোনও রাখঢাকের তোয়াক্কা না করিয়া তিনি সরাসরি দেশের হিন্দুত্ববাদী বিদ্বেষোন্মাদ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। সেই দিক হইতে দেখিলে, তাঁহার মতো সাহসী হিন্দুত্ব প্রচারক-প্রশাসক এই দেশে বিরল। সংখ্যালঘু মানুষ কিংবা সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষদের নিধনের প্রত্যক্ষ সহায়তাই যে ‘কর্তব্য’, তাহা তিনি আলোকের মতো স্পষ্ট আর জলের মতো সরল করিয়া দিয়াছেন।
কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ গোরক্ষক সম্পর্কে তাঁহার বিশ্ববীক্ষাটি খুলিয়া বলিয়াছেন। তাঁহার মতে, গোরক্ষকদের সংঘর্ষ লইয়া যাহা হইতেছে, তাহা অত্যন্ত অকারণ বাড়াবাড়ি। এমন ঘটনা নেহাত স্বাভাবিক। বাস্তবিক, গণনিধন যে কতটা স্বাভাবিক, বুঝাইতে গিয়া তিনি উদাহরণও দিয়াছেন: ১৯৮৪। যোগীদের দুর্ভাগ্য, বার বার বিভিন্ন প্রসঙ্গে এই একই ১৯৮৪ সালের শিখবিরোধী দাঙ্গার উল্লেখ করা ছাড়া তাঁহাদের উপায়ান্তর থাকে না। সেই বৎসরের দাঙ্গা চরিত্রে অতিশয় ভয়ানক, এখনও তাহার সম্পূর্ণ বিচার সম্ভব হয় নাই, সকল অপরাধী শাস্তি পায় নাই— এই সকল তথ্য অনস্বীকার্য। তবে তাহার সঙ্গে ইহাও মানিতে হইবে যে, একই আক্ষেপ ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকাণ্ড বিষয়ে, কিংবা ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গা বিষয়েও করা সম্ভব। ২০১৪ সালের পর হইতে এই দেশে যে প্রভূত পরিমাণ গণনিধন ঘটিয়া চলিতেছে, সেইগুলির ক্ষেত্রেও এই অভিযোগ করা সম্ভব। সত্য বলিতে, বুলন্দশহরের ঘটনার ‘স্বাভাবিকতা’ বুঝাইতে যদি চুরাশির শিখবিরোধী দাঙ্গার উল্লেখ ছাড়া বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের হাতে আর কিছু না থাকে, তাহা হইলে বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে আসলে এক প্রকার সার্টিফিকেট দেওয়া হইতেছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না!
আসল কথা, প্রশাসন শব্দটির অর্থ যদি দাঁড়ায় রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও জিঘাংসার কর্মকাণ্ড, যদি সমস্ত নাগরিকের সুযোগসুবিধার দিকে লক্ষ রাখিবার নীতিটি প্রথমেই প্রশাসনের কর্তব্যতালিকা হইতে বাদ পড়ে— তাহা হইলে এমনই ঘটিবার কথা। প্রশাসনের কাজ বলিতে পড়িয়া থাকে কেবল রাজনৈতিক গুন্ডাবাহিনীর সমর্থন, ভরণপোষণ ও অভিযোগক্ষালন। সাংবিধানিক পদে থাকিয়াও সংবিধান লইয়া ছেলেখেলা করা চূড়ান্ত অনৈতিক, মনে করাইয়া দিয়াছে আশি জন প্রাক্তন আমলার স্বাক্ষর-সংবলিত সাম্প্রতিক চিঠিটি। এই চিঠিতে যোগী আদিত্যনাথের পদত্যাগ দাবি করা হইয়াছে। অবশ্য, সংবিধান-মান্যতার প্রশ্নই যদি ওঠে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই প্রতিবাদ-পত্র অরণ্যে রোদনের অধিক গুরুত্ব পাইবে বলিয়া মনে হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy