ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ স্মরণীয় করিয়া রাখিতে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষের উপস্থিতি তামিল রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছে। লিবারেশন টাইগারদের সশস্ত্র প্রতিরোধ ধ্বংস করিয়া রাজাপক্ষে বিশ্বব্যাপী তামিলদের প্রবল বিরাগভাজন। ভারতে তাঁহার পদার্পণ তাই ভারতীয় তামিলদের না-পসন্দ। ইহা আন্দাজ করিয়াই রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার তামিলপ্রধান উত্তর প্রদেশের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণকে সঙ্গে লইয়া সফরে আসিতে চাহিয়াছিলেন। বিঘ্নেশ্বরণ এই যুক্তিতে রাজাপক্ষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন যে, ইহাতে ভারতীয় তামিলদের কাছে ‘ভুল’ বার্তা যাইবে। এই উপলক্ষে তামিলনাড়ুর প্রায় সব কয়টি রাজনৈতিক দল সমস্বরে রাজাপক্ষকে আমন্ত্রণের নিন্দায় মুখর হইয়াছে। অতীতেও বিভিন্ন উপলক্ষে তামিল খণ্ডজাতীয়তা সরব হইয়াছে। রাজাপক্ষের আমন্ত্রণ সেই ধারায় নূতন সংযোজন।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে এই খণ্ডজাতীয়তাবাদী আবেগ বরাবরই এক নির্ণায়ক উপাদান। পেরিয়ার-আন্নাদুরাইয়ের আত্মমর্যাদার আন্দোলন ছিল একান্ত ভাবেই ভারতীয় জাতীয়তার প্রতিদ্বন্দ্বে তামিল প্রাদেশিকতার আত্মঘোষণা। পরবর্তী কালে হিন্দি ভাষা বা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তামিল ভাষা ও সংস্কৃতির আত্মপ্রতিষ্ঠার মধ্যে সেই খণ্ডজাতীয়তার এক ধরনের জাতীয়তায় উত্তরণের প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার তামিলদের সহিত একাত্মতাকে সেই বর্গের জাতীয়তা বলিয়া গণ্য করা কঠিন, বরং ইহার মধ্যে এক ধরনের অতিজাতীয়তার লক্ষণ রহিয়াছে। ইহার ইতিহাস পুরানো। সেই ইতিহাসের বহু অভিঘাত পার হইয়াও, এবং রাজীব গাঁধীর হত্যার পরেও, সীমান্ত-অতিক্রমী তামিল অভিমান কার্যত অক্ষত থাকিয়াছে। ভারতের কোনও জাতীয় দল তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে যে অদ্যাবধি দাঁত ফোটাইতে পারিল না, তাহার কারণ নিহিত রহিয়াছে তামিল জাতীয়তার এই বহির্ভুক্তির ঐতিহ্যে।
শ্রীলঙ্কার উত্তর প্রদেশের তামিল মুখ্যমন্ত্রী বিঘ্নেশ্বরণ যখন ভারত সফরে রাজাপক্ষের সঙ্গী হইতে অস্বীকৃত হন, তখন ভারতীয় তামিলদের মনে আঘাত লাগার সম্ভাবনাই তাঁহাকে নিবৃত্ত করে। যেন শ্রীলঙ্কার তামিল-অধ্যুষিত জাফ্না ভূমি আর ভারতের তামিলনাড়ু এক অভিন্ন ভৌগোলিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক একক। যেন মাঝখানে পক প্রণালী বলিয়া কোনও তরঙ্গসঙ্কুল জলবিভাজিকা নাই। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সুসম্পর্ক রচনার কূটনৈতিক দায়ও নয়াদিল্লিকে প্রায়শ তামিল জাতীয়তার যজ্ঞভূমিতে উৎসর্গ করিয়া দিতে হয়। আত্মপরিচয়ের রাজনীতি অনুশীলন করা দেশের সব জনগোষ্ঠীই কমবেশি একই ধরনের সুবিধাবাদ অনুশীলন করে। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নামে, রাজ্যের হাতে অধিকতর আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনের দাবির মোড়কে নিজ গোষ্ঠী, জাত বা উপ-জাতের সংকীর্ণ স্বার্থরক্ষায় কেন্দ্রকে বাধ্য করিয়া চলে। সেই সব খণ্ডজাতীয়তার সহিত বোঝাপড়ার মাধ্যমেই ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশ হইয়াছে, হইবে। কিন্তু বোঝাপড়ার পথ প্রায়শই উপলবন্ধুর। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার ইনিংস সূচনার আগেই তাহা টের পাইতেছেন। ইহা কেবল জয়ললিতার সহিত তাঁহার সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রশ্ন নহে, তামিল অভিমানের সহিত ভারতের জাতীয় স্বার্থের সাযুজ্য প্রতিষ্ঠার অনেক বড় প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy