শেক্সপিয়র অভ্রান্ত। নামে কিছু আসে যায় না। আকাশবাণী আজ অবধি সরকারের বাণীমাত্র, শাসক দলের মত প্রচারের চাপে প্রসার ভারতী সতত অ-প্রসারিত। বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎকার প্রচারের আগে তাহা কাটছাঁট করিবার বিষয়ে প্রসার ভারতীর প্রধান জহর সরকারের বক্তব্য দেখাইয়া দিয়াছে, স্বাধীনতার বয়স ছয় অতিক্রম করিয়া সাত দশকের নিকটবর্তী হইলেও সরকারি প্রচারমাধ্যম স্বাধীন হয় নাই, এখনও তাহার উপর রাষ্ট্রের নজরদারি এবং খবরদারি অব্যাহত। মোদীর সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে তাঁহার প্রতিক্রিয়া জানাইয়া দেয়, প্রসার ভারতীর কাজকর্মে সরকারি হস্তক্ষেপের ধারা এমন ভাবে চলিতেছে যে, এক জন প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ আমলার পক্ষেও তাহা হজম করা কঠিন। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সদুক্তি নাগরিকরা শুনিয়াছেন ও হাসিয়াছেন। ‘প্রসার ভারতী স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকার তাহার কাজে হস্তক্ষেপ করে না’— এমন একটি সম্পূর্ণ অ-বিশ্বাস্য কথা উচ্চারণের সময় মন্ত্রিবরের মুখের একটি রেখাও কাঁপিল না! দিল্লি দরবার হইতে বিদায় লইতে হইলেও তাঁহার কাজের অভাব হইবে না, অন্য মঞ্চ প্রস্তুত থাকিবে।
মন্ত্রী উপলক্ষমাত্র, প্রকৃত অপরাধ মন্ত্রের। নীতির। ‘সরকারি প্রচারমাধ্যম’-এর ধারণাটির মূল নীতিই ভ্রান্ত, অন্যায়, গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণমাধ্যমের প্রধান কাজ সত্যের অন্বেষণ এবং উন্মোচন। সেই কাজ স্বাধীনতা দাবি করে। বিশেষত রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রণ হইতে স্বাধীনতা। এই বিষয়ে তর্ক উঠিলেই রাষ্ট্রবাদীরা ব্রিটেনের দৃষ্টান্ত দেখাইয়া বলেন, সে দেশে তো বিবিসি রাষ্ট্রনির্ভর, তাহা হইলে ভারত কী দোষ করিল? এই যুক্তিতে দুইটি বড় ভ্রান্তি অথবা প্রবঞ্চনা আছে। এক, ব্রিটেনের সমাজ ও রাজনীতিতে অনেক কিছুই হয়, যাহা আইননির্ভর নহে, প্রথা ও রীতির দ্বারা চালিত। রাষ্ট্র তথা রাজনীতিকদের অনেক বিষয়ে অনেক ক্ষমতা থাকিলেও সে দেশে তাঁহারা সেই ক্ষমতা ব্যবহার করেন না— রাজা বা রানির নিরন্তর ‘অক্রিয়তা’ তাহার পরম নজির। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখিতেও এই ধারা কাজ করিয়া চলিয়াছে, সরকার টাকা দেয় বলিয়া সরকারের গুণ গাহিতে হইবে, এমন কোনও দায়ের প্রশ্নই ওঠে না, স্বশাসন সেখানে— বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে— প্রকৃত স্বশাসন। ভারত অন্য বস্তু।
দ্বিতীয়ত, বিবিসি’র সরকারি সহায়তার যুক্তি নিয়ন্ত্রণ নহে, সামাজিক দায়। বাজারের প্রতিযোগিতায় সাফল্যের শর্ত পূরণ করিতে হইলে সামাজিক ভাবে প্রাসঙ্গিক উচ্চমানের অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করা যাইবে না, বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থেই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক, এই যুক্তি লইয়া নিশ্চয়ই তর্ক চলিতে পারে, কিন্তু ভারতে সেই তর্ক অপ্রাসঙ্গিক, কারণ এ দেশে সরকারি প্রচারমাধ্যম আর যাহাই করুক, উৎকর্ষের সাধনা করে নাই। কী নীতি, কী অভিজ্ঞতা, কোনও দিক হইতেই প্রচারমাধ্যমের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। দূরদর্শনকে সম্পূর্ণত বেসরকারি হাতে তুলিয়া দেওয়া বিধেয়। তাহার পর কী হইবে, বাজার স্থির করিবে। সরকার যদি কিছু প্রচার করিতে চাহে, তাহা বিজ্ঞাপন হিসাবে বাজারের নিয়ম মানিয়া প্রচার করাই বিধেয়। তাহার জন্য কোনও প্রসার ভারতীর প্রয়োজন নাই। বস্তুত, একটি সাড়ম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের প্রয়োজন কী, তাহাও আদৌ স্পষ্ট নহে। কথাটি পরবর্তী সরকার বিবেচনা করিলে দেশের মঙ্গল, রাজকোষেরও সাশ্রয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy