জনসভার মঞ্চ হইতে যে সরকারি কর্মীদের পড়িয়া পাওয়া ছুটি ঘোষণা করা চলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বে পশ্চিমবঙ্গ তাহা শিখিয়াছে। সম্প্রতি তিনি আরও একটি জনসভার মঞ্চে দাঁড়াইয়া, সম্ভবত হাততালি কুড়াইবার উদগ্র বাসনাতেই, যে কাজটি করিলেন, তাহা অভাবনীয়— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনভঙ্গির কথা মাথায় রাখিয়াও অভাবনীয়। শালবনিতে এক জনসভায় সাইকেল বিলি করিবার পর মুখ্যমন্ত্রী বলিয়া বসিলেন, জিন্দল শিল্পগোষ্ঠী যদি দ্রুত কাজ শেষ না করে, এবং কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত যদি জমিহারা পরিবারগুলিকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা মাসোহারা না দেয়, তবে প্রশাসন ‘ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে’। হুমকির সুরটি প্রচ্ছন্ন রাখিবার কোনও চেষ্টাই মুখ্যমন্ত্রী করেন নাই। মুখ্যমন্ত্রী, হয়তো তাঁহার পরিচিত অপরিণামদর্শিতার কারণেই, হুমকির তাৎপর্যটি বিবেচনা করেন নাই বলিয়াই অনুমান। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ নামক শিল্পশ্মশানে কাহারও আগ্রহ নাই। তদুপরি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান যদি কোনও রীতিনীতির তোয়াক্কা না করিয়া, শিষ্টাচার শিকায় তুলিয়া জনসভা হইতে হুমকি দিতে থাকেন, তাহার ফল অনুমেয়। নবান্নে কি এমনই স্থানাভাব যে জিন্দল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের ডাকিয়া বৈঠক করিবারও জায়গা নাই? না কি, প্রশাসনকে একেবারে মাঠে নামাইয়া আনাই সাব্যস্ত হইল?
বিনিয়োগ ‘বিশ্বাস’-এর উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বা বিশ্বাস বহুকালই পলাতক। দীর্ঘ বিনিয়োগ-খরা কাটাইতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সচেষ্ট হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু রাজনীতির ঘোলা জলে সেই চেষ্টা ডুবিয়া মরিয়াছে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সেই ঘোলা জলের কারবারিদের অন্যতম ছিলেন, কথাটি শিল্পমহল ভুলে নাই। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করিতে চাহিলেই রাজনীতি তাহা করিতে দিবে, এমন বিশ্বাস শিল্পপতিদের না থাকিলে দোষ দেওয়ার উপায় নাই। বিনিয়োগের জন্য যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গে তাহার নামমাত্র নাই। রাজ্যের এমনই অবস্থা যে আদালতকে নিয়মিত পুলিশকে তিরস্কার করিতে হয়, কর্তব্য স্মরণ করাইয়া দিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে যে দুর্নীতি-রাজ প্রবর্তিত হইয়াছে, তাহা একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা নাই, এবং অদূর ভবিষ্যতে থাকিবে, সেই সম্ভাবনাও নাই। অনুব্রত মণ্ডল আর মনিরুল ইসলামরা যে মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহ হইতে বঞ্চিত হন নাই, শিল্পমহল তাহাও দেখিতেছে। অনেকের ধারণা, প্রতিহিংসাপরায়ণ হিসাবেও শিল্পমহলে মুখ্যমন্ত্রীর কিঞ্চিৎ খ্যাতি আছে। যে রাজ্যের এমন অবস্থা, সেখানে যদি মুখ্যমন্ত্রী জনসভা হইতে শিল্পগোষ্ঠীকে হুমকি দিতে থাকেন, তাহার ফল কী হইতে পারে, প্রশাসন ভাবিয়াছে কি?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদা শিল্প এবং কলার মধ্যে গুলাইয়া ফেলিয়াছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁহার ধারণার উন্নতি ঘটিয়াছে, এমন কোনও প্রমাণ মিলে নাই। পশ্চিমবঙ্গ কেন ‘শিল্পবান্ধব’, তাহা ব্যাখ্যা করিতে মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের কথা বলিয়াছিলেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে তাহা যে শিল্পশ্মশানের অভিজ্ঞান, মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত বুঝিতে পারেন নাই। শিল্প বিষয়ে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের এমন অজ্ঞানতা মারাত্মক। তাঁহার শাসনের তিন বৎসরাধিক সময়কালে শিল্পের জন্য কিছুই হয় নাই। এমনকী, যে শিল্পের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী অন্তরের টান অনুভব করেন, সেই চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যেও নহে। চিত্রতারকারা তাঁহার আগে-পিছে ঘুরিয়াছেন। কেহ সাংসদ হইয়াছেন, কেহ বিধায়ক আর কেহ কারিগরি শিক্ষা সংসদের সভাপতি। কিন্তু তাহাতে শিল্পের কোনও উপকার হয় নাই। তিনি সম্ভবত কোনও শিল্পের গুরুত্বই বোঝেন না। নচেৎ, জনসভা হইতে জিন্দল গোষ্ঠীকে হুমকি দেওয়ার অপরিণামদর্শিতা হইতে বিরত থাকিতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy