পনেরো বৎসর পূর্বের তুলনায় গোটা দুনিয়ার মানুষ আজ গড়ে ভাল আছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে রাষ্ট্রপুঞ্জের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট এক কথায় বলিবে, হ্যাঁ। সাহারা অবতল আফ্রিকাতেও গড় আয়ু পাঁচ বৎসর বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু, কে কতখানি ভাল আছেন, সবার ভাল থাকা সমান হারে বাড়িল কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এত অল্প কথায় মিলিবে না। ১৯৯০ সালের তুলনায় আরও ২৬০ কোটি মানুষের নিকট শুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছাইয়াছে, ইহা যদি ভাল থাকিবার উদাহরণ হয়, তবে প্রতি রাত্রে আশি কোটি মানুষ অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাইতে যান, এই উদাহরণটিকে বিপরীত মেরুতে রাখা চলে। এ়ডস, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব কমিয়াছে, কিন্তু প্রতি দিন ১৮,০০০ মানুষ বায়ুদূষণের ফলে মারা যাইতেছেন। সংসদীয় রাজনীতিতে মহিলাদের অংশীদারিত্বের অনুপাত বাড়িয়াছে, কিন্তু দুনিয়ার আঠারোটি দেশে এখনও মহিলাদের চাকরি করিতে হইলে স্বামীর লিখিত অনুমতি প্রয়োজন হয়। দুনিয়ার প্রত্যেকে যে সমান ভাল নাই, তাহা জানা কথা। সদ্য-প্রকাশিত মানব উন্নয়ন রিপোর্ট জানাইয়াছে, ভাল না থাকিবার প্রধান কারণ বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা এবং বিবিধ সামাজিক প্রথা। সংখ্যালঘুরা যেমন পিছাইয়া আছেন, উদ্বাস্তুরাও তেমনই পশ্চাদপদ। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের উন্নয়ন ঢের কম। ভারতেই যেমন জন্মের প্রথম পাঁচ বৎসরের মধ্যে মরিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। অর্থাৎ, উন্নয়নের সহিত ক্ষমতার সম্পর্কটি কতখানি দৃঢ়, বর্তমান রিপোর্ট তাহা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইল।
উন্নয়নের প্রশ্নটি অর্থনীতির নহে, মূলত রাজনীতির। অধিকারের রাজনীতির। সেই রাজনীতি স্থানীয় স্তরেরও বটে, জাতীয় স্তরেরও বটে, আবার আন্তর্জাতিকও বটে। সম্পত্তিতে মহিলাদের অধিকারের স্বীকৃতির দাবিতে যেমন লড়াই প্রয়োজন, তেমনই উদ্বাস্তুদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থানের দাবিতেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে চাপ বজায় রাখিয়া চলা বিধেয়। সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় লড়াই জারি রাখা প্রয়োজন। এইগুলি রাজনৈতিক প্রশ্ন— কাহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে হইবে, কাহার দাবিতে সরব হইতে হইবে, তাহা স্থির করিয়া দেয় রাজনীতির বোধ। বর্তমান সমাজের বৃহত্তম অসুখ এই রাজনীতির অভাব। সমাজ ক্রমে অ-রাজনৈতিক হইতেছে। ফলে, সার্বিক ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়িতে থাকিলেও তাহার পুনর্বণ্টনের ক্ষেত্রে অসাম্য আরও বাড়িবে বলিয়াই আশঙ্কা। সমস্যা গোটা দুনিয়ার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেমন সেই সমস্যার একটি মুখ, ভারতে নরেন্দ্র মোদীও তাহাই।
উন্নয়নের সূচকে ভারত গত বৎসর যেখানে ছিল, এই বৎসরও কার্যত সেখানেই আছে। অর্থাৎ, মাঝারি উন্নয়নের স্থিতাবস্থা। ভারতের স্থান পাকিস্তান, বাংলাদেশের খানিক উপরে, আর শ্রীলঙ্কা, মলদ্বীপের বেশ খানিক নীচে। কিন্তু, অরাজনীতির অসুখ ভারতকে ক্রমে পিছাইয়া দিতে পারে, সেই আশঙ্কাটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে ভারতের দুইটি ব্যবস্থা প্রশংসা পাইয়াছে। প্রথমটি সংরক্ষণের নীতি, দ্বিতীয়টি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প। দুইটি নীতিই সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে উন্নয়নের মূলধারায় লইয়া আসিবার প্রয়াস। এবং, অ-রাজনৈতিক সমাজের নিকট দুইটি নীতিই সমান অগ্রহণযোগ্য। সমস্যা হইল, যাঁহারা এখন দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে, তাঁহাদের মনও অন্তত কর্মসংস্থানের নীতির প্রতি তেমন সদয় নহে। ফলে, আশঙ্কা থাকিয়াই যায়, চুঁয়াইয়া পড়া উন্নয়নের মোহে ভারত ক্রমে সর্বজনীন উন্নয়নের নীতি হইতে সরিয়া আসিতে পারে। তাহার ফল মারাত্মক। ক্রমে আরও অসম হইয়া চলা দুনিয়ায় সাম্যের গান গাওয়া কঠিন কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy